ভিড় আর যানজটের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা যারা ছুটে যাই বিভিন্ন শহরে, রাজ্যে বা অন্য কোনও দেশে... তাদের জন্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে লুকিয়ে আছে এমন কিছু জায়গা যেগুলো এখনও আদতে রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। ভৌগোলিক অবস্থানের সুবাদে অথবা অপরিচিত হওয়ার দরুণ এই জায়গাগুলোতে এখনও পর্যটকদের ভিড় সেভাবে হয় না। এইসমস্ত জায়গাগুলো নিয়ে অনেকেই বেশি কথা বলেন না; সম্ভবত তাঁদের ভয় হয় যদি পর্যটকদের বাড়তি ভিড়ে নষ্ট হতে শুরু করে সেই স্থানের সৌন্দর্য। তবে আশা রাখছি, যেসকল পর্যটকেরা দু-দণ্ড শান্তির খোঁজে এই রকম দুর্গম জায়গায় ছুটে যাবেন, কোনও ধরনের আবর্জনা ছড়িয়ে জায়গাগুলোর নির্মলতা নষ্টের থেকেও তারা যথাযথ বিরত থাকবেন। তাহলে আর অপেক্ষা কীসের, আসুন জেনে নেওয়া যাক লং আইল্যান্ড সম্পর্কে।
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ বলতে আমাদের ভাবনা মোটামুটি পোর্ট ব্লেয়ার, নীল আইল্যান্ড আর হ্যাভলক আইল্যান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারই মাঝে লুকিয়ে এই আশ্চর্য দ্বীপ।
লং আইল্যান্ড
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে বোটে করে প্রায় ৬ ঘণ্টা দূরত্বে এই ছোট্ট দ্বীপটি। শুভ্র বেলাভূমিতে নেই কোনও ট্যুরিস্ট। স্থানীয় মানুষ বলতে ২০০০ সাল নাগাদ উপকূলবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা হাসিখুশি একদল অভিবাসী।
লং আইল্যান্ডে কী কী দেখবেন
ছোট হলেও লং আইল্যান্ডে দ্রষ্টব্য জিনিসের কিন্তু কোনও অভাব নেই, এমনটা বলা যেতে পারে।
লালাজি উপসাগর
হাইক করে বা বোটে করে চলুন লালাজি উপসাগর
আপনি যদি হাইক করতে ভালোবাসেন তাহলে লালাজি উপসাগরে পৌঁছনোর জন্যে আছে একটি অসাধারণ সুন্দর রাস্তা। লং-আইল্যান্ডের প্রধান এবং একমাত্র গ্রাম থেকে দ্বীপটির একপ্রান্তে সাদা বালির সমূদ্রতট বরাবর এগিয়ে গেছে এই তিন ঘণ্টার পথ। সমুদ্রতটের বদলে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গেলে এক বা দু-ঘণ্টা সময়েই পৌঁছে যাবেন গন্তব্যস্থলে। বোটে করেও যেতে পারেন, খরচা ২৫০০ টাকা।
স্নোরকেলিং বা ডাইভিং-এর মাধ্যমে যেতে পারেন জলরাশির গহীনে, পেতে পারেন সামুদ্রিক জীবেদের দেখা
এখানকার জলরাশি শান্ত এবং স্বচ্ছ, তাই ডাইভিং বা স্নোরকেলিং জাতীয় ওয়াটার স্পোর্টসের জন্যে আদর্শ। মাত্র ২০০ টাকার বদলে সারাদিনের জন্যে স্নোরকেলিং-এর মুখোশ ভাড়া করে সারাদিন কাটাতে পারেন জলের তলায়। চারপাশে আছে ডাইভ করার মতো বেশ কিছু জায়গা। ডাইভিং-এর সরঞ্জামের জন্যে আইল্যান্ডের বিভিন্ন জায়াগায় আপনি দরদাম করতে পারেন। সাধারণত ডাইভ প্রতি খরচ ২৫০০ টাকা মতো পড়বে।
ব্লু প্ল্যানেট
কিছুদিন আগে অবধি ব্লু প্ল্যানেট আর তার ছিমছাম ঘরগুলি ছাড়া লং আইল্যান্ডে আর কোনও থাকার জায়গা ছিল না। বর্তমানে কিন্তু দ্বীপের দু-দিকে ব্লু প্ল্যানেটের মালিকরা থাকার বন্দোবস্ত করেছেন। একদিকে ট্রি হাউস, বিচ থেকে ১০ মিনিট দূরে, তাতে আছে ১০টি পাতাছাওয়া ঘর। জমিটির মাঝখানে বড় পাদাউক গাছের ছায়ায় ঘরগুলি থাকে বেশ ঠান্ডা।
বোটে করে ঘুরে আসুন গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্যে
ভারতবর্ষের সমগ্র ম্যানগ্রোভ অরণ্যের এক-পঞ্চমাংশ ( যার আয়তন প্রায় ৯৯৬ বর্গ কিলোমিটার) অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। বারাতাং দ্বীপ থেকে লং আইল্যান্ড-ইয়েররাটা জেটি ফেরির মাধ্যমে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের এক অংশে যাওয়া যায়। ফেরি করে দ্বীপে পৌঁছে সেখান থেকে বোটে চড়ে প্রথমে একটি ক্ষীণ জলপথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে, তারপরে দেখতে পাবেন এই ঘন অরণ্যের বিস্তৃত রূপ। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের চূড়ায় সূর্যালোকের বিচ্ছুরণের সৌন্দর্য দেখতে হলে ধরে ফেলুন সকাল ৭টার প্রথম ফেরি।
ঘুরে আসুন আশেপাশের ছোট্ট দ্বীপগুলো থেকে
বোট ভাড়া করে ঘুরে আসুন মার্কস বে, বাটন আইল্যান্ড বা জনমানবশূন্য গিটার দ্বীপের মতন আশেপাশের নানা দ্বীপ থেকে। উপর থেকে দেখলে দ্বীপটির আকৃতি অনেকটা গিটারের মতো, তাই এই নামকরণ করা হয়েছে।
কী কী খাবেন :
স্থলভূমি থেকে এত দূরে এই ছোট্ট সামুদ্রিক গ্রামে শহুরে খাবারদাবার আশা করা একটু ভুল, কিন্তু চিন্তা করবেন না। ব্লু প্ল্যানেটে পাবেন ভারতীয় খাবারদাবার, সঙ্গে রয়েছে অতুলনীয় স্বাদের টাটকা সি ফুড, সঙ্গে চা, কফি আর টাটকা ফলের রস। দক্ষিণ ভারতীয় খাবার ভাল লাগলে আছে লক্ষ্মী হোটেল, এখানে উত্তর ভারতীয় স্ন্যাকসও পাবেন। আর লোকমুখে শোনা যায়, কর্নার বারে গেলে সোডার বোতলে পাবেন "স্পেশাল মিক্স"। আর আলকোহল চাইলে পাবেন রাস্তার দুধারের ছোটখাটো দোকানে।
কখন যাবেন :
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে আন্দামানের আবহাওয়া সবথেকে মনোরম হয়ে ওঠে, তাই পর্যটকদের ঢলও নামে এই সময়ে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে আবহাওয়ার আবার উন্নতি হয়। তার আগে অবশ্য জুন মাস থেকে লং আইল্যান্ডে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে থাকে, আবহাওয়ায় আর্দ্রতার পরিমাণও যথেষ্ট বেড়ে যায় এই সময়েই।
কীভাবে পৌঁছবেন :
আন্দামান ও নিকোবরের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আপনি লং আইল্যান্ড পৌঁছতে পারবেন।
আকাশপথে : ভারতের সমস্ত বড় শহর থেকেই পোর্ট ব্লেয়ারের ফ্লাইট পাবেন। সুলভতম ফ্লাইট টি চেন্নাই থেকে, দাম ১১০০০ টাকা থেকে শুরু।
জলপথে : চেন্নাই আর কলকাতা থেকে ফেরি করে চলে আসতে পারেন পোর্ট ব্লেয়ার। দেখে নিন টিকিট আর যাত্রাসময় সম্পর্কিত সকল তথ্য।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে লং আইল্যান্ড
জলপথে : পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রতি সোম, বুধ, শুক্র এবং শনিবার সকাল ৬.১৫ তে ফেরি ছাড়ে লং আইল্যান্ডের প্রতি, সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। টিকিটের দাম জনপ্রতি ১৯০ টাকা। তবে টিকিট আগে থেকে কেটে রাখবেন, নইলে ফুরিয়ে যাবে।
সড়কপথে : পোর্ট ব্লেয়ারের স্টেট ট্রান্সপোর্ট বাস স্ট্যান্ড থেকে ২০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে বাসে করে চলে যান রাঙ্গাত। সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মতো। রাঙ্গাত থেকে ১০ টাকা দিয়ে আরো আধঘণ্টা বাসে করে চলে যান ইয়েররাটা ফেরি। সেখান থেকে ৯ টাকার টিকিটে পেয়ে যাবেন লং আইল্যান্ডের ফেরি। ফেরি ছাড়ে দৈনিক সকাল ৯টায় এবং বিকেল ৪টায়, গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা।
কীভাবে ঘুরবেন :
লং আইল্যান্ড ছোট্ট একটি দ্বীপ, কোনো মোটরগাড়ি এখানে পাবেন না। তাই পায়ে হাঁটাই একমাত্র এবং শ্রেষ্ঠ উপায়।
কোথায় থাকবেন :
লং আইল্যান্ডে থাকার জায়গা মূলত দুটি
খরচ
সংলগ্ন বাথরুমের সাথে বড় ঘর : ২০০০টাকা (লিটল আন্দামান) ; সংলগ্ন বাথরুম আর তিনটি বেড-ওলা ফ্যামিলি রুম : ২৫০০টাকা (গিটার); সংলগ্ন বাথরুমের সাথে ছোট ডাবল রুম : ১৫০০টাকা (স্ট্রেট, রস আর স্মিথ); বাজেট রুমের খরচ : ৫০০টাকা
ব্লু প্ল্যান্ট রিসোর্টে অবশ্য পাবেন বাঁশের কটেজ। ২ বেডরুম কটেজের জন্যে রাতপ্রতি খরচ ৩০০০টাকা, ১ বেডরুম কটেজ নিলে খরচ ২০০০টাকা।
ফরেস্ট রেস্টহাউস
পর্যটকদের জন্যে সম্প্রতি খুলে দেওয়া হয়েছে নতুন এক ৩টি ঘর এবং সাধারণ সুযোগসুবিধা সমৃদ্ধ ফরেস্ট রেস্টহাউস। দিনপ্রতি খরচ ৫০০টাকা। বুকিং করতে ফোন করুন এই নম্বরে : ০৩১৯২-২৭৪২১০
আপনি কি গেছেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ? লং আইল্যান্ডের কথা শুনে আপনারও কি সেখানে ট্রিপে যেতে ইচ্ছে করছে? আপনার ছুটি কেমন কাটলো?