আমাদের ভারতবর্ষ একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ | উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, আবার পূর্বে বঙ্গোপসাগর, ব-দ্বীপ অঞ্চল থেকে পশ্চিমে মরুভূমি অঞ্চল গোটা ভারত জুড়েই জলবায়ু, পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষ আর তাদের জীবন যাত্রা সমস্ত কিছুর মধ্যে তারতম্য লক্ষ করা যায় |
সমস্ত ভ্রমণপিপাসু মানুষের গোটা ভারতবর্ষ পর্যবেক্ষণ করার একটা সুপ্ত অভীপ্সা থাকেই, তাই তাদের জন্য সুন্দরবন এবং ব-দ্বীপ অঞ্চল ভ্রমণ এক্কেবারে অন্যরকমের অভিজ্ঞতার আস্বাদ এনে দিতে পারে | সুন্দরবনের গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ব-দ্বীপ অঞ্চল সমৃদ্ধ উদ্ভিদ এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রধান সম্পদ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় গড়ে তুলতে চাইলে একবার সুন্দরবনে অবশ্যই আসতে হবে |
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্কটি একটি ব- দ্বীপ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে | গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী মিলিত হয়ে যেখানে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়েছে, সেই সংযোগস্থলে এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের উৎপত্তি | এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সুন্দরী গাছের নাম অনুসারেই এই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয় | ম্যানগ্রোভ অরণ্যের খ্যাতনামা গাছগুলো হল সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া ইত্যাদি | অন্যদিকে সুন্দরবনের প্রাণীজ সম্পদের জন্য সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্কটি ইউনেস্কোর দ্বারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমাও পেয়েছে সম্প্রতি|
২০১১ সালে ভারতের গণনা অনুযায়ী সুন্দরবনে মোট ১৮০ টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে তার মধ্যে ভারতে মাত্র ৭৪টি বর্তমান | রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও এখানে কুমির, ঘড়িয়াল, হরিণ ইত্যাদি পশুর সমাবেশ ঘটেছে | এই ম্যানগ্রোভ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় ৭,৯০০ বর্গমিটার, যা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের আখ্যায় ভূষিত হয়েছে |এর মধ্যে ১৬৪০ বর্গ মিটার ভারতের অন্তর্ভুক্ত, যা পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত |
ভ্রমণবৃত্তান্ত
প্রথম দিন:
কলকাতা থেকে ট্রেন ধরে পৌঁছে যান ক্যানিং স্টেশন| স্টেশন থেকে ১টা ম্যাজিক গাড়ি চেপে ঘণ্টা খানেকের দূরত্বে পৌঁছে যান গদখালী | এই প্রসঙ্গে বলে রাখি সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আপনারা স্থানীয় টুরিস্ট এজেন্সি অথবা অনলাইন যে কোনও ট্যুর এজেন্সি থেকে আগে থেকে পরিকল্পনা করেও যেতে পারেন | অথবা গদখালী পৌঁছেও আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী সুন্দরবন ভ্রমণের প্ল্যানিং করে নিতে পারেন | তবে আগে থেকে পরিকল্পনা করে, ট্যুরিস্ট এজেন্সির সাহায্যে গেলে নৌকা ভাড়া কম হয় এবং এই বন্যপ্রাণ সুরক্ষিত স্থানটি ভ্রমণের জন্য বনদপ্তর থেকে সহজেই অনুমতি মিলে যায় | গদখালী জায়গাটিকে ছোট্ট বন্দর বললে কিছু ভুল হবে না | গদখালী থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে রাজকীয় নৌকা | সম্পূর্ণ সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আপনার একমাত্র সঙ্গী হবে এই নৌকা বা বোটটি | নৌকোগুলোতে আপনার জন্য থাকা-খাওয়া বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধার যথেষ্ট বন্দোবস্ত রয়েছে |
নৌকায় চাপার পরেই আপনার জন্য প্রাতঃরাশ পরিবেশন করে দেবেন নৌকায় থাকা সহকারীবৃন্দ | এই সময়ের মধ্যেই আপনি পৌঁছে গেছেন লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে | আপনার নৌকার চারিদিকে শুধু জল আর জঙ্গল, ও হ্যাঁ! আর সঙ্গে রয়েছে সূর্যমামা | এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে যান আপনার পরবর্তী গন্তব্য গোসাবাতে|
নৌকো থেকে নেমে ঘুরে নিন স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন ও রবীন্দ্রনাথের বাংলোতে | তৎকালীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বাংলোটি বেশ সাজানো গোছানো | মজবুত কাঠ দ্বারা নির্মিত এই বাংলোর সম্মুখে রয়েছে অসংখ্য ফুলের বাগান | গোসাবা থেকে নৌকায় উঠেই আপনার জন্য হাজির হয়ে যাবে দ্বিপ্রাহরিক আহার | এবার গন্তব্যস্থল পাখিরালয় | আবার নৌকা রায়মঙ্গল নদী বক্ষে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলবে | চারিদিকে আবারও অসংখ্য জলরাশি, মাঝে মাঝে নদী তীরবর্তী ছোট ছোট গ্রাম দেখতে দেখতে বুঝতেই পারবেন না কখন সূর্য অস্তাচলে চলে গেছে, আর আপনারাও পৌঁছে গেছেন পাখিরালয়ে | সেখানে থেকে পৌঁছে যান আপনার হোটেল | পাখিরালয় গ্রামটি এখানকার অন্য গ্রামের তুলনায় বেশ জনবহুল | ইচ্ছা করলে সন্ধের দিকে গ্রামের চারপাশটা একটু ঘুরে নিতে পারেন | রাত্রে খাবার খেয়ে, নিরালা শান্ত পরিবেশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে নিশ্চিন্তে চলে যান ঘুমের দেশে |
দ্বিতীয় দিন:
সকালে উঠে রেডি হয়ে পৌঁছে যান নদীর তীরে আপনার অপেক্ষমান নৌকোতে | আজকের গন্তব্য হল বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ অরণ্য পর্যবেক্ষণ | প্রাতঃরাশ করতে করতে আপনার বোট ধীরে ধীরে আপনাকে নিয়ে যাবে গভীর অরণ্যের উদ্দেশ্যে| এই যাত্রাপথে প্রথমেই আপনাদের জন্য রয়েছে পাখীর কাকলি, বাদর আর তার মা-এর লুকোচুরি খেলা, পরিযায়ী বক জাতীয় পাখির জল পান করা ইত্যাদি | এই সব দেখতে দেখতেই আপনি পৌঁছে যাবেন আজকের প্রথম গন্তব্য সজনেখালি টাওয়ার | এখানে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ দর্শন হবে লালমুখো হরিণের সঙ্গে | ওয়াচ টাওয়ার থেকে আপনি দেখতে পাবেন চারিদিকে গভীর অরণ্য, জংলী সরীসৃপ, হরিণের দল প্রভৃতি |
এরপরের গন্তব্যটি হল দোবাঁকি | আবার নৌকাটি ছোট ছোট খাঁড়ি পেড়িয়ে এগিয়ে চলবে সামনের দিকে আরও | এই খাঁড়িগুলোর দুই তীরে আছে লবনাক্ত জলের উপর জীবনধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যানগ্রোভ অরণ্য | দোবাকি পৌঁছে প্রথমেই দর্শন করে নিন এই অরণ্যের দেবী বনবিবির | টাওয়ার পৌঁছনোর ঠিক আগেই রয়েছে বনবিবির ছোট্ট মন্দির, যেখানে স্থানীয় মানুষ তাঁর নিত্য অর্চনা করেন | কিছু দূর এগোনোর পর টাওয়ার থেকে ঘন অরণ্যটা পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারেন | এই অরণ্যের মধ্যে আপনি দেখা পাবেন হরিণ, বাঁদর, নানান পরিযায়ী পাখি, মাছরাঙা, আর ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই দেখা পেলেও পেতে পারেন সুন্দর বন এর প্রধান সম্পদ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের |
এবার হোটেল ফেরার পালা | দোবাকি থেকে পাখিরালয় ফেরার পথে খাঁড়ির তীরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আপনি সাক্ষাৎ পেতে পারেন কুমির এবং বিষধর সাপের | এই খাঁড়ির পথ ধরে এগোতে গিয়ে একটা সময় দেখবেন আপনার বোটটি পৌঁছে গেছে মোহনার দিকে | চারিদিকে সুদূর বিস্তৃত জলরাশি আর তার থেকে একটু দূরে বঙ্গোপসাগরের হালকা ঝলক চোখে পরবে|বিকেলের রোদের মলিন আলো মেখে, শীতের ঠান্ডা আমেজ এবং সুন্দরবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসুন হোটেলে | সন্ধেবেলা হোটেলে বনফায়ার এর সাথে আপনার জন্য রয়েছে ছৌ- নৃত্য প্রদর্শন | এখানকার স্থানীয় মানুষ , পর্যটকদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ছৌ - নাচ কে রোজগারের অন্যতম পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন|
তৃতীয় দিন:
তৃতীয় দিনের সফরে আপনি ঘুরে আসতে পারেন ঝড়খালি আইল্যান্ড থেকে| বনদপ্তরের পক্ষ থেকে এখানে পশুদের একটা সেবা কেন্দ্র রয়েছে | দ্বিতীয় দিনে যদি আপনার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখার সুযোগ নাও হয়, তারা অবশ্যই এই সেবা কেন্দ্রে এসে বাঘমামাকে চাক্ষুষ করতে পারবেন |
এবার ফেরার পালা | ঝড়খালি আইল্যান্ড ভ্রমণ করে আপনার বোটে চেপে আবার ফিরে আসুন গদখালীতে |
ভ্রমণের সেরা সময়:
পর্যটকদের মতে সুন্দরবন ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস|
কাদের জন্য উপযুক্ত:
এই ভ্রমণে সব বয়েসের মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারেন | পরিবারের সমস্ত পরিজনের সঙ্গেও বা প্রিয় মানুষের সঙ্গেও যেতে পারেন |
খরচ:
শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং ট্রেন ভাড়া মাথা পিছু ২৫ টাকা মতো | ক্যানিং থেকে গদখালী ম্যাজিক গাড়ির ভাড়া মাথা পিছু ৪০ টাকা | গদখালী থেকে ২ রাত ও ৩ দিনের মাথাপিছু খরচ ৩৫০০ টাকা মতো (থাকা, খাওয়া,সাধারণ হোটেল ভাড়া, নৌকাবিহার সহযোগে ভ্রমণ অন্তর্ভুক্ত )| আপনি আপনার ইচ্ছা অনুসারে, পছন্দ মতো হোটেল ভাড়া করেও যেতে পারেন |
কোথায় থাকবেন :
সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য পাখিরালয় জায়গাটি রাত্রিবাসের জন্য আদর্শ | এখানে ছোট বড় অনেক গুলো হোটেল ও ভিলা রয়েছে | হোটেল এর ভাড়া ৮০০ -১৫ ,৫০০ টাকার মধ্যে উপলদ্ধ আছে |
আহার :
নিরামিষ বা আমিষ আহার আপনি আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী পছন্দ করে নিতে পারেন | খাদ্যরসিক এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের একমাত্র ডেস্টিনেশন হয়ে উঠতে পারে এই সুন্দরবন |
কীভাবে যাবেন:
ট্রেনে:
ভারতের যে কোনও ছোট বড় শহর থেকে পৌঁছে যান হাওড়া, কলকাতা স্টেশন বা শিয়ালদহ স্টেশনে | হাওড়া এবং কলকাতা স্টেশন পৌঁছলে সেখান থেকে ছোট গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যান শিয়ালদহ স্টেশন | তারপর লোকাল ট্রেন ধরে ঘণ্টা দুয়েক দূরত্বে পৌঁছে যান ক্যানিং স্টেশন | ক্যানিং থেকে ৩০ কিমি দূরত্বে পৌঁছে যান গন্তব্যে |
বিমানে :
ভারতের যে কোনও বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে যান কলকাতা বিমানবন্দর | বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে শিয়ালদহ পৌঁছে লোকাল ট্রেনে ক্যানিং পৌঁছতে পারেন | আবার বিমানবন্দর থেকে ছোট গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ১০০ কিমি দূরত্বে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে |