ভ্রমণপ্রেমী এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী মানুষদের জন্য সিকিম একেবারে আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র বলা যায়। আয়তনের দিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য হলেও, সিকিম শহর জুড়ে রয়েছে এক অদ্ভুত শৈল্পিক নীরবতা। প্রশান্তি। যেন কোনও অত্যাশ্চর্য গোপনীয়তা লুকিয়ে রয়েছে শহরটির পরতে পরতে। পাহাড় ঘেরা সিকিমের এই অপরূপ নৈসর্গিক চিত্রই পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে। সিকিমের প্রতিটি ছোট ছোট গ্রাম, রাস্তা রূপকথা দিয়ে ঘেরা। এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে ‘কিউজিং’ বা ‘কেউজিং’ গ্রামটির কথা। দক্ষিণ সিকিমের রাভাংলা থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরেই রয়েছে এই কেউজিং গ্রামটি। ভুটিয়া উপভাষায় কেউজিং শব্দের অর্থ হল 'গম ক্ষেতের জমি’ বা 'ল্যান্ড অফ চেস্টনাট ফরেস্ট' বা সসিং হিসেবেও বলা যায়। মনে রাখা প্রয়োজন এই শব্দগুলোর সঙ্গে খুব সম্ভবত স্থানিক চাষাবাদের সম্পর্ক বিশেষভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
এই গ্রামে বসবাসকারী অধিকাংশ ব্যক্তিই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। গ্রামের পরিবেশ আপাতভাবে শান্ত, নিবিড় এবং সৌম্য। ছোট এই গ্রামে প্রায় ৩০টির মতো ঘর রয়েছে। বলা যায় একটা দীর্ঘ সময় ধরে সিকিমের এই নিরিবিলি গ্রামটি পর্যটকদের প্রায় অগোচরে ছিল। পরে অবশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য পরিষেবার কারণে গ্রামটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই প্রসঙ্গে অবশ্য উল্লেখ করতে হয়, সিকিম ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) এবং এনজিওর সহযোগিতায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নতির জন্য কেউজিং পর্যটন উন্নয়ন কমিটি তৈরি করা হয়। ২০০২ সাল থেকে তা কার্যকর হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কেউজিং গ্রামবাসীদের ভূমিকাও যথেষ্ট ছিল। এই গ্রামের প্রায় ১৫টি ভুটিয়া পরিবার নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি কমিটি। এই কমিটি বা কমিউনিটি ট্যুরিজমের কারণেই এই গ্রামের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। এই পরিবারগুলিকে মূলত আগত পর্যটকদের আতিথেয়তা, অতিথিদের পরিচালনা ও ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করার বিষয়ে একটি বিস্তৃত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এই প্রশিক্ষণ পর্বের পরেই গ্যাংটক ভিত্তিক একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি মারফত ছুটির প্যাকেজগুলি তৈরি করা হয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই বিপণনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। প্যাকেজটিতে হোমস্টে, ঐতিহ্যবাহী ভুটিয়ার নৃত্য পরিবেশনা, ট্রেক গাইডেন্স এবং অন্যান্য আরও অনেক বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে।
নিরিবিলি জীবনের এক মোহনীয় সৌন্দর্য
এই গ্রামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল গ্রামের শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশের বৈচিত্রতা। কিউজিং গ্রাম ঘিরে যেন ছড়িয়ে রয়েছে একটা অদ্ভুত মিষ্টি পাহাড়ি গন্ধ। পাহাড়প্রেমী মানুষেরাই বোধহয় ওই গন্ধের আস্বাদ নিতে পারবেন।
আপনি কেউজিংকে অন্বেষণ করার সঙ্গে সঙ্গে আপনি কোনও স্থানীয় ড্রামিন নামক ইনস্ট্রুমেন্টসটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, সেইসঙ্গে এই গ্রামে বেশ কিছু লোককথা বা লোককাহিনি-র জনপ্রিয়তার সঙ্গে পরিচিতি ঘটবে। যা আপনার মনে রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দিতে বাধ্য। পাহাড় এবং বনঘেরা এই অঞ্চলেই রয়েছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ মঠ-বিহার, দক্ষিণ-পশ্চিমে তাশাইডিং (২২ কিমি), পশ্চিমে মংব্রু এবং পেমায়ংটসন মঠ (৩৩ কিলোমিটার), দক্ষিণ-পূর্বে রালং এবং রাভাংলা (১৫ কিমি), পূর্বে ডলিং (৯ কিমি) এবং উত্তরে বন, বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য। কেউজিং তিব্বতি কার্পেট বয়ন কেন্দ্র এবং একটি লোকজ শিল্পের জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ।
কেন যাবেন ?
অ্যাডভেঞ্চারের জন্য
রাভাংলা, সিকিম
কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত এই গ্রামটির প্রতি বহু পর্যটকই আকর্ষণবোধ করে থাকেন। পেলিং এবং রাভাংলার আশেপাশের এই গ্রামটি ট্রেকিং এবং হাইকিং ট্রেলের জন্য আদর্শ এমনটা বলা যেতে পারে। শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক গোপন বিহারগুলিকেও আপনি দেখতে পারবেন। একইসঙ্গে সমগ্র অঞ্চলটি বৌদ্ধ প্রার্থনার পতাকা দ্বারা সজ্জিত। বৌদ্ধ বিহারগুলোতে উচ্চারিত স্তবমন্ত্র নিঃসন্দেহে আপনাকে মুগ্ধ করবে। পাহাড়ি সৌন্দর্যের আলগা নৈসর্গিক দৃশ্যের পাশাপাশি রাভাংলা বেস হিসেবে ধরে, কেউ মেনাম এবং টেন্ডং পাহাড়ে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে ট্রেকিং পদ্ধতি সহজ। কষ্টসাধ্য নয়। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সমগ্র ট্রেকিং পথটির রূপরেখা এগিয়ে চলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আলোর সঙ্গে পাহাড়ি বনাঞ্চলেরও রং পরিবর্তিত হতে থাকে, যারফলে এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয় পুরো ট্রেকিং পথটা জুড়ে।
টেমি, সিকিম
পাহাড়ি সৌন্দর্যের মধ্যে যারা হারিয়ে যেতে চান, যারা প্রকৃতির রূপ-রস এবং গন্ধকে অন্তরের অন্তস্থলে উপভোগ করতে চান, তারা আশেপাশের গ্রামগুলি বিশেষ করে বারফুং, বখিন এবং মাম্ব্রু গ্রামগুলি ঘুরতে পারেন। এই প্রত্যেকটি গ্রামেরই বিশেষত্ব হল গ্রামের একধরনের শৈল্পিক নীরবতা এবং এখানকার বসবাসকারী মানুষদের সহজ-সরল জীবনভঙ্গি। গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষই স্বনির্ভর জীবনচিন্তায় বিশ্বাসী। সিকিমের টেমি এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলো ঘুরে দেখার সময়ে অবশ্যই টেমি চা-বাগান থেকে চা-পান করতে ভুলবেন না। চা-প্রেমী বাঙালিদের জন্য এ যেন এক আদর্শ জায়গা এমনটা বলাই যায়।
রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র...
এই গ্রাম থেকে আট কিলোমিটার দূরে মেনাম বন্যজীবন অভয়ারণ্য অবস্থিত। প্রায় ২০০-রও বেশি বন্য প্রজাতির পাখি এই অংশে আপনি দেখতে পাবেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি যারা পাখি পর্যবেক্ষক এবং কৌতূহলী তাঁদের জন্য এর থেকে আদর্শ জায়গা আর নেই। এই প্রসঙ্গে আরও একটা জিনিস বলে রাখা ভাল সবুজ ম্যাগপাই, ব্রাউন উড আউল, লম্বা লেজযুক্ত মিজোরনি-র জন্য যেন আপনার ক্যামেরার লেন্স এবং শাটারের ক্লিক যেন সবসময় প্রস্তুত থাকে।
কী খাবার খেতে পারেন
গম থেকে তৈরি একধরনের নাস্তা এইখানে বেশ জনপ্রিয়। নাম Zhero বা জ়েরো। নেটেল স্যুপ বা সিসনুর কম পরিচিতি থাকলেও চেষ্টা করে দেখতে হবে। অতি অবশ্যই মাংস বা শাকসব্জী এবং থুক্পায় ভরা বিশিষ্ট ময়দার ডাম্পলিং বা মোমো চেখে দেখতে ভুলবেন না যেন!
ভ্রমণের আদর্শ সময়
অক্টোবর থেকে নভেম্বর এ পর্যন্ত আনন্দদায়ক, গড় দৈনিক তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যেই থাকে। দিনে মোটামুটি রোদ থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তাই অতি অবশ্যই শীতের জামাকাপড় সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ভুলবেন না।
কীভাবে যাবেন?
গ্যাংটকের মূল শহর থেকে প্রায় ৭৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। নিকটতম বিমানবন্দরটি বাগডোগরাতে। এনজেপির নিকটতম রেলস্টেশন (নিউ জলপাইগুড়ি) ১৬০ কিলোমিটার দূরে। কেউজিং-এ পৌঁছনোর জন্য, মেলি চেকপোস্ট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাভাংলা এবং নামচি হয়ে গাড়ি চালান।
কাছাকাছি পাবেন
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল কেউজিং গ্রামটি কেবলমাত্র পায়ে হেঁটেই ঘুরে দেখতে পারেন। এর জন্য আলাদা করে কোনও ট্রান্সপোর্টের প্রয়োজন হবে না।
থাকার ব্যবস্থা
বন ফার্মহাউস (Bon Farmhouse, Kewzing)
বন ফার্মহাউস ছয় একর জুড়ে বিস্তৃত। অতিথিকে জৈব চাষের মতো স্থানীয় অভ্যাসগুলির গুরুত্ব সম্পর্কে জানানো হয়। মালিক, চেয়াং রিঞ্চেন বনপো একজন খ্যাতিমান পাখি বিশেষজ্ঞ। আপনারা আনন্দের সঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে অনেক বিষয় জানতে পারবেন।