সিমলিপাল হল নির্জন জঙ্গলে ঘেরা লাল মাটির দেশ আর এর সঙ্গেই রয়েছে সুসজ্জিত জলপ্রপাত । চারিদিকে উঁচু নিচু পাহাড়কে কেন্দ্র করে রয়েছে ঘনসবুজের অরণ্য আর এই অঞ্চলটি বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুল দ্বারা সমৃদ্ধ ।
পাহাড়, জলপ্রপাত এবং জঙ্গলে ঘেরা একটি চটজলদি অফবিট ট্রিপ -
বহুদিন ধরেই জলপ্রপাত দর্শনের জন্য ভাবছিলাম তাই বেড়িয়ে পড়লাম ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র অভয়ারণ্যের উদ্দেশ্যে। ওড়িশায় বেশ কিছু অনাবিষ্কৃত ভ্রমণ স্থান রয়েছে যা এখনও তেমনভাবে পর্যটকদের দৃষ্টিগোচর হয়নি । আর পর্যটকহীন হওয়ার কারণে সিমলিপালে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে প্রাণভরে উপভোগ করা যায় ।
যদিও অফবিট ট্রিপ প্ল্যান করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তবে সমস্যার পর যে পাওনাটা লাভ করা যায় তা অমূল্য ।
বন্যতা এবং প্রবাহমান জলপ্রপাতকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সিমলিপাল অভয়ারণ্য। এছাড়াও পাহাড়প্রেমী মানুষের জন্য রয়েছে পাহাড়। কোনও একটা পাহাড় অতিক্রম করলে দর্শন পেয়ে যেতে পারেন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা । আর পাহাড়ি রাস্তা ধরে কিছু কিলোমিটার হেঁটে গেলেই দেখা পেয়ে যাবেন জলপ্রপাতের ।
কম জনবহুল স্থান ভ্রমণের সুফল -
বারিপদা শহরের খুব কাছেই অবস্থিত সিমলিপাল অভয়ারণ্য। অন্যান্য শহরের তুলনায় এই শহরে জনসংখ্যা কম । এই শহরের নিজস্ব প্রশাসনিক এবং বিচার ব্যাবস্থা - যেমন পুলিশ স্টেশন, কোর্ট, ফায়ার স্টেশন রয়েছে। একসময় এই শহরটি এক রাজার অধীনে ছিল।পরবর্তীকালে এই রাজ-শাসনব্যাবস্থা আধুনিক শাসনব্যাবস্থায় পরিবর্তিত হয় । একসময় বারিপদা এবং সিমলিপাল অঞ্চলটি মাওবাদী এলাকা ছিল, তবে বর্তমানে এই এই জায়গাটি ভ্রমণের জন্য বেশ সুরক্ষিত ।
কলকাতা থেকে প্রায় ৫ঘণ্টা বাসে চেপে সন্ধে বেলায় পৌঁছে গেলাম বারিপদা । কম খরচে ভাল হোটেলের সন্ধান করতে করতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ময়ূরভঞ্জ প্যালেস দর্শন করব। এই প্যালেসটি সমতল অঞ্চল থেকে একটু উপরে অবস্থিত আর প্যালেসের পিছনের দিকে রয়েছে ঘন জঙ্গল। দুর্ভাগ্যবশত, প্যালেসের ভিতর তেমন কিছুই দেখতে পাইনি ।
চলুন এবার জঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা যাক -
আজ আমাদের ডেস্টিনেশন সিমলিপাল । সকালের দিকে যাত্রা শুরু করে পৌঁছে গেলাম সিমলিপালের পিঠাবাটা প্রবেশপথে। এখানে সমস্ত রকম ফর্মালিটি সেরে এগিয়ে গেলাম দ্বিতীয় চেকপোস্ট-এর উদ্দেশ্যে ।
সকালের মিষ্টি রোদ আর লাল মাটির পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মনের মধ্যে অদ্ভুত কৌতূহল জমে উঠছিল। যাত্রাপথে অনেক বন্য পাখিকে স্বাধীনভাবে উড়তে দেখলাম ।
জঙ্গল পরিদর্শনের শুরুতে এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এই গভীর অরণ্যে আধুনিক খাবারের প্রত্যাশা একেবারেই ছিল না। প্রাতঃরাশ হিসেবে শাল পাতায় পরিবেশন করা হলো কারি সহযোগে কয়েকটি বড়া এবং ডিম সিদ্ধ। ইচ্ছা করলে আপনি বনের মধুর স্বাদ চেখে দেখার জন্য মধু কিনে নিয়ে যেতে পারেন।
খাবার খেয়ে গাড়ি করে কিছু কিমি রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম জোরান্ডা জলপ্রপাত । চঞ্চলা এই জলপ্রপাতের শব্দ দূর থেকেই শোনা যায়। পাহাড়ের একটা স্থান থেকে দেখলাম সাদা ফেনার মতো একটা লম্বা জলধারা প্রবাহিত হয়ে কোনও গভীর গিরিখাতে মিলিত হয়েছে । পাখির কোলাহলের সঙ্গে চঞ্চলা জলপ্রপাতের শব্দ মিলেমিশে যেন এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে ।
জলপ্রপাত দর্শন করে আবার লাল মাটির রাস্তা, ধুলোর ঝড় পেড়িয়ে এগিয়ে চললাম । এবার আমাদের যাত্রাপথে দেখা পেলাম খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর। নদীটি ছোট বড়ো পাথরের রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলেছে মোহনার দিকে। এই গভীর অরণ্যে এই নদী দর্শন আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল । নদীর পাড়ে বসে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম । পাহাড়ি নদীর ঠান্ডা জলে পা ভিজিয়ে মনের মধ্যে এক শান্তির বীজ খুঁজে পেলাম ।
আমার মনে হচ্ছিল এই নদীটি বাড়েহিপানি জলপ্রপাত থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে এবং হ্যাঁ, আমার ধারণা সঠিকই ছিল । সারাবছর প্রবাহমান বাড়েহিপানি জলপ্রপাত থেকেই এই বুধবালাঙ্গা নদীর উৎপত্তি। এই জলপ্রপাতটি দুইটি অংশে বিভক্ত যার একটি অংশের উচ্চতা প্রায় ২৫৯ মিটার ।
সত্যি বলতে কী এই ঘন জঙ্গলে এতো বড়ো জলপ্রপাত দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেছিলাম । কাছাকাছি একটি ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে দূরের খাড়াই পাহাড় থেকে বহমান জলপ্রপাতকে বয়ে যেতে দেখলাম ।
দুপুরের রোদের ম্লান আলোকে জলপ্রপাতের সৌন্দর্য অনুধাবন করতে করতে কখন যেন লাঞ্চ-এর সময় গেছে । দুপুরে স্থানীয় মানুষদের হাতের তৈরি ভাত আর দেশি মুরগির ঝোলটা জাস্ট অমৃত মনে হল। এই অঞ্চলের মানুষরা কৃষিকার্য এবং পর্যটনের উপর নির্ভর করেই জীবন ধারণ করেন । এখানে আজও বিদ্যুৎ এবং মোবাইল সংযোগের ব্যাবস্থা নেই, তবে কিছু কিছু বাড়িতে সোলার প্যানেল চোখে পড়ে ।
এই মানুষগুলি দারিদ্রের বশবর্তী হলেও পর্যটকরা তাদের কাছে ভগবান সমতুল্য, তাই তারা পর্যটকদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেন না । এখানকার মানুষেরা সাজসজ্জা বিশেষত গৃহসজ্জাতেও বেশ পটু। এই অঞ্চল পরিদর্শন করার পর মনে হল এখানে খুব সামান্যই শিক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যাবস্থার সরঞ্জাম উপলব্ধ আছে ।
খাবার সেরে পৌঁছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে, স্থানীয় মানুষদের মতে বিকেলের দিকে টাওয়ারের কাছাকাছি একটি জলাশয়ে বন্য পশুরা জল খাওয়ার জন্য আসে। একসময় রাজারা পশু শিকারের জন্য ছাহেলা অঞ্চলটিকে বেছে নিতেন । এখানে বিশালকার ইউক্যালিপটাস গাছ এবং বড় বড় তৃণভূমির সন্ধান পেলাম ।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে কিছু বাদরের দর্শন পেলাম আর দূরে হরিণের ডাক শুনতে পেলাম। তবে যে সমস্ত পর্যটক এই অভয়ারণ্যে রাত্রিবাস করেন তারা রাতে জঙ্গলের অ্যাডভেঞ্চারকে উপলব্ধি করতে পারবেন ।
আমাদের এই ভ্রমণ প্রায় শেষ, তাই আমি ক্যামেরা বন্ধ করে একান্তে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে লাগলাম । জঙ্গলে কিছু গাছের অদ্ভুত গঠন লক্ষ্য করলাম । এমনকি যে গাছগুলি মারা গিয়েছে সেই গাছগুলিও কীট পতঙ্গ দ্বারা সংক্রামিত হয়ে নতুন শৈলীর সৃষ্টি হয়েছে । ফেরার পথে কিছু ময়ূরেরও দেখা পেলাম ।
সিমলিপাল অভয়ারণ্যটি প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে স্বর্গসম । অরণ্য পরিদর্শন করে ডান দিকে একটু এগিয়ে গেলেই দেখা পাওয়া যাবে সীতাকুণ্ড। এই ছোট্ট জলাশয়টির উল্লেখ মহাভারতেও পাওয়া যায় । অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বনদপ্তর থেকে সীতাকুণ্ড দর্শনের অনুমতি পাওয়া গেল না । তবে ড্রাইভারকে একটু অনুরোধ করায় তিনি নিয়ে গেলেন সীতাকুণ্ড । আপাতদৃষ্টিতে জায়গাটি আমার বেশ অপরিচ্ছন্ন মনে হলো । মূলত সীতাকুণ্ড হল একটি জলপ্রপাত, এছাড়াও এখানে একটি মন্দিরও রয়েছে । মন্দির দর্শন করে ফিরে এলাম বারিপদা । সেই রাতেই বাস ধরে আমরা কলকাতা পৌঁছে গেলাম । সপ্তাহান্তে ভ্রমণের জন্য সিমলিপাল ভ্রমণ এক্কেবারে আদৰ্শ । আর এই বন্য পরিবেশ সমস্ত পর্যটকদের মুগ্ধ করবেই । আশা রাখি ভবিষ্যতেও এমনি স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশের সাক্ষী থাকতে পারব।
সিমলিপাল সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য
বারিপদা শহরের নিকটে অবস্থিত সিমলিপাল অভয়ারণ্য । এই অভয়ারণ্যে প্রবেশের জন্য মোট দুইটি প্রবেশ পথ রয়েছে পিঠাবাটা এবং জাশিপুর। জাশিপুর অঞ্চলটিও গভীর অরণ্য দ্বারা পরিবেষ্ঠিত । আপনি এখানে রাত্রিবাস করেও সমস্ত জঙ্গল পরিদর্শন করতে পারেন । এখানে বনবিভাগ পরিচালিত সমস্ত সুযোগ সুবিধা সহযোগে একটি ফরেস্ট হাউস আছে। তবে এই ফরেস্ট হাউস ভ্রমণ এবং রাত্রিবাসের জন্য আপনাকে অনলাইনে বুক করতে হবে ।
বারিপাদা পৌঁছনোর জন্য প্রতিদিন এসপ্ল্যানেড থেকে অনেকগুলি বাস উপলব্ধ আছে । মাত্র ৫ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন । এক্ষেত্রে আগে থেকে টিকিট বুক করারও কোনও প্রয়োজন নেই । বারিপাদাতে কম খরচে লাক্সরি হোটেল আছে, আর হোটেল বুকিং এর জন্য আপনার ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্রের প্রয়োজন। ভ্রমণকালীন সময়ে আমরা হোটেল সুভদ্রাকে বেছে নিয়েছিলাম ।
বারিপাদা পৌঁছানোর জন্য নিকটতম রেলস্টেশন হল বালাসোর, কিন্তু ভুবনেশ্বর থেকেও খুব সহজেই এখানে পৌঁছে যেতে পারেন । এই অঞ্চলে অনেকগুলি বিখ্যাত ভ্রমণ স্থান আছে, যেমন - চাঁদিপুর, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, দেবকুণ্ড ইত্যাদি। বারিপাদা বাস স্ট্যান্ড থেকে সিমলিপাল যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যাবেন । যেহেতু সিমলিপালের দূরত্ব বেশ অনেকটাই তাই সাথে জল এবং স্ন্যাক্সস জাতীয় খাবার নিয়ে যেতে ভুলবেন না । সিমলিপালের দর্শনীয় স্থানগুলি হলো -জলপ্রপাত, কুন্ড, কুমির সংরক্ষণ কেন্দ্র, অর্কিড গ্রীন হাউস আর ভাগ্যে থাকলে বাঘ এবং হাতির দেখা পেতে পারেন। এই অভয়ারণ্য পরিদর্শন করার জন্য গাইডের সাহায্য নেওয়াই ভাল।
ফরেস্ট অফিসের ক্যান্টিনে নিরামিষ এবং আমিষ দুই ধরণের খাদ্যের যথেষ্ট ব্যাবস্থা আছে। শৌচালয়ের ব্যাবস্থাও যথেষ্ট ভাল কিন্তু তাদের দূরত্ব বেশ অনেকখানি । সিমলিপাল ভ্রমণের জন্য অক্টোবর থেকে মার্চ মাসটি আদৰ্শ । গরমে তীব্র দাবদাহের ফলে সিমলিপাল ভ্রমণের জন্য অনুকূল নয় । আর বর্ষার সময় এই অভয়ারণ্য বন্ধ থাকে ।
পরিশেষে এইটুকুই বলার, পরিবেশ বান্ধব হয়ে ভ্রমণ করুন ।
বিজ্ঞপ্তি : যেহেতু এখানে আধুনিক রাস্তার ব্যাবস্থা নেই, সমস্ত রাস্তাই লাল মাটি, তাই প্রচুর ধুলোর সম্মুখীন হতে হবে, সুতরাং ভ্রমণের সময় সাদা পোশাক পড়ে ভ্রমণ না করাই ভাল।