"উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে এমন এক নির্জন বিচ, যেখানে প্রতিদিন সমুদ্র অস্তিত্ত্ব থেকে মুছে যায়, আর ফিরে আসে প্রায় কয়েক ঘণ্টা পর। এ যেন প্রাকৃতিক এক বিস্ময়, যার উদ্ঘাটন আজ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি"
ট্রেনে করে ভুবনেশ্বর যেতে যেতে সহযাত্রীদের কথোপকথন থেকে উড়ে এল এই কথাগুলো। জিজ্ঞাসা করতে তাঁরা জানালেন, বালেশ্বর বা বালাসোর স্টেশনে নেমে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই চাঁদিপুর।
আস্তে আস্তে বালেশ্বর স্টেশন আসাতে মনের খেয়ালেই নেমে পড়লাম। রাত ৯টার সময় এরকম অজানা অচেনা জায়গায় নেমে পড়া কিন্তু একেবারেই উচিত নয়। থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না, আর এর আগে এই ভাবে হোটেল খুঁজতে গিয়ে কিন্তু বাজেটের থেকে বেশি টাকা খরচ করে ফেলেছি।
প্রথম দিন
বালাসোর
বালেশ্বর বা বালাসোর ছোট্ট নিরিবিলি এক আদ্যোপান্ত ভারতীয় মফস্সলের টাউন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার করলে পাবেন হরেক রকম থাকার ব্যবস্থা - সমস্ত সুবিধাযুক্ত ফোর স্টার হোটেল থেকে ছারপোকা আর আরশোলা ভর্তি একদম ছাপোষা হোটেল; সবই আছে এখানে। ও.টি. ডি.সির পান্থনিবাস চেনের লাক্সারি হোটেলের শাখাও এখানে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে।
খিরাচোরা গোপীনাথ মন্দির
বৈষ্ণব ভাবধর্মের উপর ভিত্তি করে বালাসোর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে প্রতিষ্ঠিত খিরাচোরা গোপীনাথ মন্দিরটি সত্যিই অনন্যসুন্দর। খিরা নামক দুধ দিয়ে তৈরি বিশেষ মিষ্টি প্রসাদের জন্যে এই মন্দির বিখ্যাত। মন্দিরের ভিতরে অবস্থিত কদম্ব গাছের গন্ধে গোটা মন্দির চত্বর মেতে ওঠে।
দ্বিতীয় দিন
চাঁদিপুর
পরের দিন সকালে ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম চাঁদিপুর বিচ দেখতে। উড়িষ্যা কিন্তু বিখ্যাত সস্তায় নানা মুখরোচক খাবারের জন্য। তাই এক প্লেট পুরি ভাজি, আর গরমাগরম পকোড়া দিয়ে ব্রেকফাস্ট করার লোভ সামলাতে পারলাম না। রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিচে যাওয়ার জন্যে ট্যাক্সি পাবেন, একদিকের ভাড়া ৮০০ টাকা। স্থানীয় জনজীবনের স্বাদ নিতে চাইলে শেয়ার জিপে করেও এগোতে পারেন। ২০ টাকা ভাড়া, তবে গন্তব্যের দিকে রওয়ানা দিতে দিতে সময় লাগে প্রায় ঘণ্টাখানেক। জিপে আস্তে আস্তে প্যাসেঞ্জার ভরার ব্যাপারটা দেখতে কিন্তু বেশ মজার, ড্রাইভার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় আরও বেশি বেশি লোক নেওয়ার। এবারে তো আস্ত একটা এক্সট্রা গাড়িরই প্রয়োজন হল।
বালাসোর থেকে চাঁদিপুর পৌঁছাতে সময় লাগলো প্রায় ১ ঘণ্টা। বিচ অঞ্চলে আমাকে স্বাগত জানাল একসারি পামগাছ। তটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল, যেন আমার চোখের সামনেই সমুদ্র পিছু হটতে শুরু করল, নিমেষে পিছিয়ে গেল কয়েক কিলোমিটার। বহু মানুষ দৌড়ে গেল সমুদ্রের দিকে, গর্ত থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো শিশু কাঁকড়ার দল। আর অলস জেলেরা শুকনো বালিতেই জাল ফেলল , যাতে জল ফিরে এলে আপনা আপনি মাছ এসে ফেঁসে যায় জলে নামার কয়েক ঘণ্টার কষ্ট না করেই।
সমুদ্রের দিকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যাওয়র পর জেলেদের ডাকে হুঁশ ফিরল। যে কোনও মুহূর্তে সমুদ্র ফিরে আসতে পারে, তখন এতদুরে থাকা একেবারেই নিরাপদ হবে না।
চাঁদিপুর সমুদ্র সংলগ্ন ছোট্ট বিচ টাউন, তাই হাতের কাছেই পাবেন কিছু রেস্টুরেন্ট এবং বিচ শ্যাক। মুখরোচক এবং বিখ্যাত কিছু ওড়িয়া ডিশ, যেমন মাছের কারী বা কাঁকড়া খেতে চাইলে উড়িষ্যা পর্যটন বিভাগের নিজস্ব রিসর্টে নিশ্চিন্তে থেকে আসতে পারেন।
তৃতীয় দিন
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির
দিন বাড়লে ফিরে আসি বালাসোরে, ঐ অঞ্চলের সমস্ত স্থানীয় মন্দিরগুলো দেখতে। উড়িষ্যার বেশিরভাগ শহরে বা গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন অনেক মন্দির, যাদের স্থাপত্যশৈলী বিশ্বনন্দিত। পাথরে খোদাই করা গল্পের মাধ্যমে যেন প্রতিটি মন্দির আমাদেরকে ইতিহাস এবং ধর্মবিশ্বাসের নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসে। বালাসোর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পঞ্চলিঙ্গেশ্বর এমনি এক মন্দির। দিনের বেলা এখানে যাওয়ার জন্যে নিয়মিত বিরতিতে বাস চলে। এই মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ হল, মন্দিরপ্রাঙ্গন থেকে নীলগিরি পর্বতের সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া।
উড়িষ্যা কিন্তু ব্যাকপ্যাকারদের জন্যে স্বর্গসম। সংস্কৃতি, খাবার দাবার, ইতিহাস, সবদিক দিয়ে সমৃদ্ধ এই রাজ্যটি তাই হয়ে উঠেছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। চাঁদিপুর আমাকে ভারতবর্ষের অদ্ভুত এক সুন্দর ঐতিহাসিক পরিমণ্ডলে নিয়ে আসতে সক্ষম, হয়তো এই রকম জায়গাগুলোর কারণেই এই আমাদের দেশ পেয়েছে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার ট্যাগনেম।
কীভাবে পৌঁছাবেন :
বালাসোর
ভুবনেশ্বর আর বালাসোরের মধ্যে স্বল্প বিরতির ব্যবধানে নিয়মিত ট্রেন চলে। সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা, আর প্যাসেঞ্জার কোচে ভাড়া ১২০ টাকা।
বালাসোর থেকে চাঁদিপুর
এই দুই জায়গার মাঝে শেয়ার জিপ আর প্রাইভেট ট্যাক্সি চলে।
ওয়ান ওয়ে ট্যাক্সি ভাড়া ৮০০ টাকা আর জিপ ভাড়া মাত্র ২০ টাকা।
বালাসোরে এদিক ওদিক
বালাসোর বিখ্যাত তার প্রাচীন মন্দিরের সমারোহের কারণে। ও.টি.ডি.সির ট্যুরিস্ট বাস প্রতিদিন সকাল সকাল ছাড়ে এবং স্থানীয় সমস্ত মন্দির ঘুরিয়ে দেখায়। জনপ্রতি খরচ প্রায় ২০০ টাকা।