দেরাস নেচার ক্যাম্প - চান্দাকা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি
বিস্তীর্ণ ঘন সবুজ অরণ্য, সুনীল জলরাশি, অদূরে ছোট পাহাড়, আকাশে টুকরো মেঘের আনাগোনা, পাখীর ডাক আর দূষণমুক্ত বাতাস – ভ্রমণপিপাসুদের পক্ষে এমন অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করা যায় না, আমরাও পারিনি । তাই যখন খোঁজ পেলাম বাড়ি (কর্মসূত্রে বর্তমানে পারাদ্বীপ) থেকে অনতিদূরে এরকম প্রাকৃতিক সম্ভার উপস্থিত, তাই বিলম্ব না করে এক রাত্রির জন্যে online reservation করে ফেললাম Odisha Forest Department এর দেরাস নেচার ক্যাম্পে । www.ecotourodisha.com থেকে বুকিং করতে হয়। আমরা নিয়েছিলাম AC Cottage Suite, খরচ ৩৫০০ টাকা প্রতি রাত্রি, GST অতিরিক্ত। প্যাকেজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত একটি ডাবল বেড AC কটেজ, ২ জন প্রাপ্তবয়স্কের breakfast, lunch এবং dinner. বুকিং করার সময় ফরেস্টের প্রবেশ শুল্ক দিতে হয় যা মাথাপিছু ৪০ টাকা প্রতিদিন।
০১লা মার্চ ২০২০ ।
সকাল ১০.৩০ টার সময় আমরা স্বামী, স্ত্রী এবং আমাদের ২.৫ বছরের কন্যা মিলে নিজস্ব গাড়িতে রওনা হলাম দেরাস নেচার ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। ভুবনেস্বর থেকে চান্দাকা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারির দূরত্ব ৪৪ কিমি এবং কটক থেকে ৩৬ কিমি। আমাদের পারাদ্বীপ থেকে পৌঁছতে অতিক্রম করতে হয় ১১৯ কিমি, সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। রাস্তা খুব ভাল। কোন toll gate পার করতে হয় না। Public transport এর সুব্যাবস্থা না থাকায় নিজেরা গাড়ি চালিয়ে অথবা গাড়ি ভাড়া করে আসাই বাঞ্ছনীয়। যাত্রাপথে পেট্রোল পাম্প এবং খাবার জায়গা – দুটোরই অভাব। তাই রওনা হবার আগে গাড়ির ট্যাঙ্ক ভরে নিতে হবে আর খাবার, পানীয় জল সঙ্গে নিয়ে নিতে হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ফরেস্টে প্রবেশের দুটি দ্বার আছে – দেরাস এবং গোদিবারি। যেহেতু আমরা দেরাস নেচার ক্যাম্পে রাত্রিযাপন করবো, তাই নিকটবর্তী দেরাস গেটে উপস্থিত হয়। Reservation receipt এর ফটোকপি দেখাতেই খুলে দেওয়া হয় ফরেস্ট গেট। ভিতরে প্রবেশ করেই বুঝতে পারি, এখানে এসে ভুল করিনি। জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা মাটির, আর তার দুই ধারে সারিবদ্ধ গাছ। রাস্তাটি গিয়েছে দেরাস ড্যামের পাশ দিয়ে। তখন ঘড়িতে প্রায় ১ টা বাজে, প্রখর সূর্যের তাপ। তাই গাড়ি থেকে না নেমে আমরা এগিয়ে চললাম নেচার ক্যাম্পের দিকে। ঠিক করলাম রৌদ্রের তাপ কমলে পরে এসে ঘুরে দেখব ড্যাম। মিনিট দশেক যাবার পর পৌঁছে গেলাম ক্যাম্পের গেটে। ভিতরে অনেকখানি জায়গায় বিস্তারিত এই property. সাইট ম্যানেজার আমাদের নির্ধারিত cottage দেখিয়ে দিলেন এবং জানালেন যে lunch প্রস্তুত। কটেজটি খুব সুন্দর, প্রশস্ত এবং পরিচ্ছন্ন। সব থেকে ভাল লাগল কটেজের সাথে লাগোয়া বারান্দাটি। নির্জনতা এবং সবুজায়নকে সঙ্গী করে এখানে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেকখানি সময়। আর দেরি না করে হাঁটা লাগালাম রেস্টুরেন্টের দিকে, ক্ষুধা নিবারণের জন্যে। খাবার জায়গাটি খুব বড় এবং পরিস্কার। ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, মিক্সড ভেজের তরকারি, পাঁপড়, সালাদ আর রসগোল্লার সমাহারে ভরপেট সুস্বাদু খাবার। খাবারের options সীমিত। রাতের খাবার কি হবে সেটা দুপুরেই জানিয়ে দেওয়া হল। আমাদের ইচ্ছে ছিল জঙ্গল পরিভ্রমণ করে দেখার। সাইট ম্যানেজারকে বলেই বুক করলাম সাফারি। এখানে জানিয়ে রাখি নিজস্ব গাড়িতে জঙ্গল পরিভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয় না। Forest department এর নির্ধারিত সাফারিতেই একমাত্র ঘোরা যাবে জঙ্গল। ২.৫ ঘণ্টার সাফারির খরচ ১৬০০ টাকা। গাড়িতে মোট ৮ জন বসতে পারেন। আমাদের সময়ে অন্য কোন tourist না থাকায় পুরো খরচটাই আমাদের দিতে হয়। সকাল ৬ টা থেকে সাফারি শুরু হয়। আমরা ঠিক করলাম দিনের শেষ সাফারিটা করবো, ৩.৩০ থেকে। আমাদের হাতে কিছুটা বাড়তি সময় থাকায় ঠিক করলাম নেচার ক্যাম্পের ভিতরটা explore করার। মোট ৫টি কটেজ, ১টি Bamboo Hut এবং ১টি Log Hut রয়েছে। এর সবকটি উপরে দেওয়া অনলাইন ওয়েবসাইট থেকে বুক করা যায়। আর রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে দেখা যায় সুবিস্তৃত ঘন সবুজের সাথে ড্যামের নীল জলরাশি। একটি মন মাতানো দৃশ্য। এরপর সঠিক সময়ে এসে হাজির হল আমাদের সাফারি গাড়ি। বেড়িয়ে পরলাম জঙ্গলের ঘ্রাণ নিতে। দুপাশের ঘন জঙ্গল ছাড়িয়ে এগোতে লাগলাম মেঠো পথ ধরে। ১৭৬ বর্গ কিমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই জঙ্গল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই জঙ্গলে রয়েছে হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ, বুনো শুওর, অন্যান্য স্তন্যপায়ী এবং বিভিন্ন পাখির দল। যদিও আমাদের দেখা মেলে শুধুই ময়ূরের। সাফারির প্রথম গন্তব্য হল একটি watch tower । টাওয়ার থেকে দেখা যায় সুদূর বিস্তারিত জঙ্গল এবং জলাশয়। ভাগ্য ভাল থাকলে জলাশয়ে জল খেতে আসা বন্যপ্রাণীর দেখা মিলতেই পারে। এরপর আমরা গেলাম গোদিবারি গেট। এই গেটের পাশেও রয়েছে একটি নেচার ক্যাম্প। এই ক্যাম্পেও online booking করে রাত্রিযাপন করা যায়। যদিও আমার অভিমত, দেরাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক বেশি। গোদিবারি গেটের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল ২টি পোষা হাতি। কচিকাঁচাদের চাহিদা মেটাতে হাতিদুটির জুড়ি মেলা ভার। সাফারির শেষ গন্তব্য হল জুমুকা ড্যাম। ততক্ষণে বেশ ভালই সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। দিনের শেষ আলোতেও বুঝতে অসুবিধে হলনা যে জায়গাটি খুবই সুন্দর। যদিও খুব কম আলো থাকায় ভাল করে ছবি তুলতে না পারার আক্ষেপ রয়ে গেল। অগত্যা আমরা ফিরে এলাম দেরাস ক্যাম্পে। টিফিনে বলা ছিল ভেজ পকোড়া এবং চা। এই টিফিনের বন্দোবস্ত কিন্তু package এর অন্তর্ভুক্ত নয়। বারান্দায় বসে ঝিঁঝিঁপোকা এবং দূর থেকে ভেসে আসা বন্যপ্রাণীদের ডাক শুনতে শুনতে কাটানো সময়য়ের স্মৃতি নিঃসন্দেহে দীর্ঘস্থায়ী হবে। রুটি, egg curry এবং রসগোল্লা সহযোগে সুস্বাদু dinner সম্পন্ন করে জংলী নির্জনতার মাঝে দিলাম জমিয়ে ঘুম।
০২য় মার্চ ২০২০ ।
দেরাস ড্যাম ভাল করে explore করার জন্যে আমরা breakfast করেই checkout করে বেড়িয়ে পড়লাম। ড্যামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিস্মিত করে দেয়। এই লেখনীর শুরুতে ব্যাবহার করা প্রতিটি বিশেষণ জায়গাটির প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। এই লেখার সাথে কয়েকটি ছবি দিলাম। যদিও মনে হয় না ছবিগুলো প্রকৃতির এই অভাবনীয় সৃষ্টির সাথে সুবিচার করতে পারবে বলে, জায়গাটি ছবির থেকে অনেক বেশি সুন্দর। বেশ কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি নিয়ে শুরু করলাম ফেরার পালা।
শহরের গতানুগতিক জীবনযাত্রা আর দূষণ থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষা করে রয়েছে একটি সুন্দর নেচার ক্যাম্প, কর্মীদের অসামান্য আতিথেয়তা আর তার সাথে রয়েছে প্রকৃতির অপরুপ সম্ভার – আর কি চাই?
জায়গাটির চাক্ষুষ নিদর্শন পেতে নিচের লিঙ্কে দেওয়া ভিডিওটি অবশ্যই দেখুন।
https://youtu.be/f1qv8FQiUEs