ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত নাগাল্যান্ড রাজ্য ঘিরে রয়েছে রহস্যময় পরিবেশ। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু জনজাতি এবং উপজাতি সম্প্রদায়ের বাস এই অঞ্চলে। এই প্রসঙ্গে বলা যায় প্রতিটি সম্প্রদায়েরই ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা এই রাজ্যে লক্ষ করা যায়। সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যা অনুযায়ী জানা গিয়েছে ভারতবর্ষের নাগাল্যান্ডে নাগা উপজাতির প্রায় ষোলোটি সম্প্রদায় বাস করে থাকেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছে আঙ্গামি, আও, চাকেসাং, কন্যাক, কুকি, কাচারি, সুমি, চাং, লোথা, প্রচুরি, তাংগুল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই প্রসঙ্গে অবশ্য বলতে হবে যে প্রত্যেকটি উপজাতি গোষ্ঠীরই রয়েছে আলাদা আলাদা উৎসব পালনের রীতি রেওয়াজ। হর্ণবিল উৎসব, মোআতসু উৎসব, সেকরেনি উৎসব, নাজু উৎসব ইত্যাদি। এক্ষেত্রে প্রতিটি উৎসব পালনের রীতির মধ্যেই রয়েছে সংশ্লিষ্ট উপজাতি সম্প্রদায়ের নিজ নিজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বজায় রেখে চলার একধরনের প্রয়াস। বলাবাহুল্য এ যেন এক ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক প্রবহমান স্রোত... এক ধারাবাহিক প্রবাহ। সুতরাং নাগাল্যান্ড ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকলে এই সকল জাতি-সম্প্রদায়ের প্রথাগত ঐতিহ্য দেখার পাশাপাশি প্রাচীন রীতি-নীতি সম্পর্কেও আপনি সচেতন হতে পারবেন।
কন্যাক উপজাতি সম্প্রদায়ের কাহিনি
এই ভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে ‘কন্যাক’ উপজাতির কথা অবশ্যই বলতে হবে। অসম-নাগাল্যান্ড সীমান্তের এই উপজাতি গোষ্ঠী অত্যন্ত দুর্ধর্ষ বলেই একসময় চিহ্নিত ছিল। বহুপ্রাচীন কালে এই উপজাতিগোষ্ঠীর কোনও পুরুষ নরমুণ্ড হাতে নিয়ে উপজাতিরই অন্তর্ভুক্ত কোনও রমণীকে প্রেম নিবেদন করে থাকতেন, এটাই ছিল সেখানকার চিরকালীন প্রথা। শিকারে পারদর্শিতার জন্য এই গোষ্ঠীর বিশেষ খ্যাতি অবশ্যই রয়েছে। তবে কালের নিয়মে এই সকল প্রাচীন রীতি-নিয়মের প্রকাশ এখন আর সেভাবে চোখে পড়ে না। শিকারের দুর্ধর্ষ সাহসিকতার বিবরণ তাঁরা ছেড়ে দিলেও ইতিহাসের পাতায় এবং প্রাচীন লোককথাতে রয়ে গিয়েছে সেই সকল বিষয়ের এক বিস্তৃত বিবরণী। রয়ে গিয়েছে সারা দেহে উলকি আঁকা যোদ্ধাদের রোমহর্ষক কাহিনি। সেই কাহিনি যতটা না রোমাঞ্চকর, তার থেকে অনেকবেশি আকর্ষক।
রোমহর্ষক সেই কাহিনি শোনার জন্য আপনাকে আর লোককথা বা লোককাহিনির উপরে বিশ্বাস করে থাকতে হবে না। আপনি একেবারে নিজের চোখেই বিষয়টির বিবরণ দেখতে পারবেন এবং জানতে পারবেন... অনুসন্ধিসু পাঠকদের মধ্যে স্বভাবতই একটা প্রশ্ন জাগতে পারে কীভাবে? এক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় হল ‘কন্যাক’ উপজাতি গোত্রের বংশধর ফেজিন কন্যাক-এর আতিথেয়তা এবং আপ্যায়ন পদ্ধতি। মূলত তিনি তাঁর বাড়িতেই ভ্রমণকারীদের স্বাগত জানাচ্ছেন এবং তাঁর পূর্বসূরীদের বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলোকে শোনার জন্য সুযোগ করে দিচ্ছেন। আপনি গল্পগুলোকে নিজের কানে শুনবেন এবং ফিরে যাবেন শতাব্দী প্রাচীন কোনও এক ইতিহাসের সময়ে...
নাগাল্যান্ডে যে সমস্ত উপজাতি এককালে বাস করত, তাদের মধ্যে ‘কন্যাক’ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি সাহসী, বীর এবং দুর্ধর্ষ ছিল। মূলত প্রধান নেতৃত্বের উপজাতিরা এই অঞ্চল জুড়ে ঘোরাফেরা করতেন এবং নিজেদের সদস্যবর্গকে রক্ষা করে থাকতেন। অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বি উপজাতির সঙ্গে সংঘর্ষ অবশ্যই হয়ে থাকত। তবে সেই সংঘর্ষের পরিণাম ছিল মারাত্মক। প্রতিদ্বন্দ্বি সদস্যদের হত্যা করা হত এবং এই প্রক্রিয়াতে মুণ্ড বা মস্তক ছেদনেরও একপ্রকার রেওয়াজ ছিল। কন্যাকেরা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বির ছেদিত মাথা নিয়ে গ্রামে ফিরিয়ে আসলেই, উপজাতির সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিরা সেই ব্যক্তিকে বিশেষভাবে সম্মান করতেন এবং তাঁর জয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে পারতেন। একইসঙ্গে তাঁদের বিশ্বাস ছিল এই প্রক্রিয়ার ফলে পুরো গোত্রটি সমৃদ্ধ হবে এবং বছরের ফলনও উন্নত হবে। উপজাতির সার্বিক সমৃদ্ধিলাভে নিযুক্ত নেতাদের প্রতি ছিল তাঁদের বিশেষ সম্মান। এমনকী প্রধান নেতাদের সম্মান জানাতে একটি উদযাপনের আয়োজন করা হত এবং এখানেই একজন যোদ্ধার মুখের উপর উলকি আঁকা হত - যা উপজাতির সবচেয়ে স্বীকৃত বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিতি পায়।
সময় সঙ্গে সঙ্গে এবং আধুনিকতার পাশাপাশি, কন্যাক সহ এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপজাতি তাঁদের প্রথাগত উপায়গুলি সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রতিটি অজস্র প্রজন্মের সাথে, ঐতিহ্যবাহী ‘কোনিয়াক’ অনুশীলনগুলি, তাদের দেহের উলকি আঁকানো সহ হারিয়ে যেতে শুরু করে।
কন্যাক হেডহান্টারের প্রপৌত্র কন্যা ফেজিন কন্যাক মতো খুব অল্প উত্তরসূরিই রয়েছে যারা এই প্রায় হারিয়ে যাওয়া উপজাতির দলিল ও প্রচার করার জন্য নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন। ফেজিন সম্প্রতি সোম (যা একসময়ে কন্যাকদের দখলে অঞ্চল) ঘুরেছেন, উপজাতির অবশিষ্ট সদস্যদের সাথে দেখা করেছেন এবং তাদের আকর্ষণীয় কাহিনি শুনেছেন। তিনি সেই সমস্ত উপাদান একটি সফল ' দ্য কন্যাক : লাস্ট অফ দ্য ট্যাটুড হেডহান্টাস্' ('The Konyaks: Last of the Tattooed Headhunters') বইতে সংকলন করেছেন এই প্রসঙ্গে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হ'ল ফেজিন কোনওভাবেই থামতে চান না এবং কন্যাকদের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রক্ষার জন্য যা কিছু করা দরকার তা তিনি করবেন এমনটাই মন স্থির করেছেন। তিনি, তাঁর পিতাকে সঙ্গে নিয়ে এখন ‘কন্যাক টি রিট্রিট’ পরিচালনা করছেন, একটি প্রচলিত চা-এস্টেটের মাঝখানে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী হোমস্টেটি। ঘরোয়াভাবে থাকার পাশাপাশি, আদিবাসী-উপজাতি এই গোষ্ঠীর প্রচুর আকর্ষণীয় গল্পগুলি ‘কন্যাক টি রিট্রিট’-এ থাকার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি উপভোগ করতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
খুব সাধারণ চা এস্টেট। হোমস্টেটিতে রয়েছে দুটি শোবার ঘর (সংযুক্ত বাথরুম সহ), একটি থাকার জায়গা এবং খাবারের জায়গা এবং একটি ওপেন কিচেন। এই বাংলোটি খুব মৌলিক ভাবে পরিকল্পিত, তবে অভ্যন্তরে রয়েছে মজ্জাগত ঐতিহ্যের শিকড়। দেওয়ালগুলিতে চোখে পড়বে বিরল নিদর্শনগুলি এবং উপজাতীয় রেখাযুক্ত চিত্রগুলি, যা আপনাকে প্রাচীন কোনও সময়ে নিয়ে যাবে। অ্যান্টিক ফার্নিচারগুলি কেবল পুরনো ঐতিহ্যকেই যুক্ত করে না, বরং এটি কন্যাক উপজাতির আকর্ষণীয় কাহিনি শোনার জন্য এক আদর্শ জায়গা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
খাবার এবং অন্যান্য
আপনি যদি পশু প্রেমিক হয়ে থাকেন এবং ‘কন্যাক টি রিট্রিট’ দেখার জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন, তাহলে দেখবেন খামারে প্রায় ৮০টি গরু, ২০টি ছাগল এবং বহুসংখ্যক মুরগি রয়েছে যা মোটামুটি আশপাশের চত্বরেই ঘোরাঘুরি করে। শুধু তা-ই নয়, আপনি সম্পত্তিটির অন-সাইট কুকুর এবং বিড়ালকে যথাক্রমে পিট এবং কালীকে জড়িয়ে, তাদের সঙ্গে খেলাধুলো করতে করতেই আপনার অনেকটা সময় কেটে যাবে এমনটা বলা যায়। ‘কন্যাক টি রিট্রিট’-এর সমগ্র কাজ পরিচালনার জন্য যে দলটি নিযুক্ত তারা জৈব কৃষিতে প্রকৃত অর্থে বিশ্বাসী করে এবং এখানে দেওয়া খাবারের মধ্যেও আপনি সেই আস্বাদ পেয়ে থাকবেন। রান্নাঘরের কর্মীরা খাঁটি স্থানীয় খাবার তৈরিতে তাজা, খাঁটি জৈবজাতীয় শাকসব্জী ব্যবহার করেন। এছাড়াও, আপনি চাইলে নিজে থেকে বাগানের গাছ থেকে খাঁটি কমলালেবু খেতে পারেন, তাতে আপনি পাবেন জৈবসারের গুণাগুণের পাশাপাশি প্রকৃতির প্রকৃত আস্বাদ।
খরচ
সমস্ত খাবার এবং চা-এস্টেট সফর সহ ‘কন্যাক টি রিট্রিটে’-এর প্রতি রাতের খরচ শুরু মোটামুটি ২৫০০ টাকা থেকে।
ভ্রমণের আদর্শ সময়
অক্টোবর থেকে মে মাসের মাঝামাঝি মাসগুলো নাগাল্যান্ড ভ্রমণ করার জন্য আদর্শ এমনটা বলা যেতে পারে। এইসময়ে বৃষ্টিপাত সেভাবে হয় না, আবহাওয়া মনোরম এবং শুষ্ক থাকে এমনটা বলা যায়।
আপনি কীভাবে নয়াদিল্লি থেকে এই স্থানটিতে পৌঁছতে পারবেন তা এখানে বলা হল:
বিমানের মাধ্যমে: নয়াদিল্লি এবং আসামের ডিব্রুগড় বিমানবন্দরের মধ্যে একটি সরাসরি যেতে পারেন। বিমানমাশুল বা ভাড়া ৬০০০ টাকা থেকে শুরু হয়। বিমানবন্দর থেকে হোমস্টেতে যেতে আরও পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে (১৪০ কিলোমিটার)।
ট্রেনে করে: নয়াদিল্লি থেকে শিবাসাগর রেল স্টেশন পৌঁছতে প্রায় ৪২-৫০ ঘণ্টা সময় লাগে ‘কন্যাক টি রিট্রিট’-এ পৌঁছতে, রেলস্টেশন (৭০ কিমি) থেকে তিন ঘণ্টার পথ।
সুতরাং, শতাব্দীপ্রাচীন গোষ্ঠীসম্প্রদায়ের কথা শুনতে, একইসঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশে থাকার জন্য অবশ্যই আপনার প্ল্যানিং শুরু করে দিন। নতুন বছরে। ‘নিউ নর্ম্যাল’-এর সূচনা একটু হেরিটেজ কোনও স্থান ঘিরে না হয় হল!
নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।
বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন।
(এটি একটি অনুবাদকৃত আর্টিকেল। আসল আর্টিকেল পড়তে এখানে ক্লিক করুন!)