মেঘালয়ের দ্বকির নিবিড় নিস্তব্ধতার মধ্যে কিঞ্চিত আঁকা বাঁকা সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে স্ফটিকস্বচ্ছ নীলচে সবুজ উমঙ্গত (Umngot) নদী। একরাশ ঘন সবুজ আর রুক্ষ পাথুরে গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ উমঙ্গত নদী, দ্বকির অন্তর্ভুক্ত শ্নংপ্রেঙ (Shnongpdeng) নামে এক ছোট্ট গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে বাংলাদেশের সমতলে।
স্ফটিকস্বচ্ছ জলে যেন আকাশের প্রতিফলন, নৌকাগুলিকে দেখেও মনে হয় তারা যেন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে উপেক্ষা করে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। শহরাঞ্চল থেকে ছুটে আসা পর্যকটদের মনে এখানকার শান্ত-শীতল নীরব পরিবেশ এক আলাদা অন্তর্লীন সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে তোলে। খানিক পরে আপনিও অবশ্য উমঙ্গতের অলস ছন্দের সঙ্গে নিজের তাল মেলাতে বাধ্য হবেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভাল এখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই, কিন্তু আছে পাখিদের কলতান আর পাহাড়ি পোকাদের বিনবিন শব্দ, যা আপনাকে নিয়ে যাবে শহুরে আধুনিক গতানুগতিক দৈনন্দিন জীবনের দুশ্চিন্তা এবং ছন্দ থেকে অনেকখানি দূরে।
উমঙ্গত মূলত দ্বকি এবং তার অন্তর্গত ছোট্ট শ্নংপ্রেঙ গ্রামের মধ্যে দিয়ে যায়। আমরা দ্বিতীয় জায়গাটাই বেছে নিয়েছিলাম, কারণ শ্নংপ্রেঙ এখনও লোকচক্ষুর অনেকটা আড়ালে। খুব একটা পর্যটকদের ভিড় এখানে চোখে পড়ে না, একরাশ উৎসাহ নিয়ে আমরা দুপুর নাগাদ শীলং থেকে শ্নংপ্রেঙ এর উদ্দেশ্যে মোটামুটি ঘণ্টা তিনেকের ড্রাইভে রওনা দিলাম। শিলঙের ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ছোটার সঙ্গে সঙ্গে উত্তম দা, আমাদের গাড়ির ড্রাইভার, চালিয়ে দিলেন বিহু গান। প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে তাল মেলালো এখানকার চিরন্তন ঐতিহ্যের ছন্দও...
দ্বকির কাছাকাছি, উত্তম দা দূর থেকে নিচের দিকে দেখিয়ে দিলেন ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। আমরা কিন্তু জানলা দিয়ে ঘাড় বের করে তাকিয়েও কোনো স্পষ্ট বর্ডার বা সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম না। দেখলাম শুধু এক ঝাঁক রঙিন ছাতার সারি, আর তার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো কিছু মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, আলগা রোদের আমেজে কাটাচ্ছে অলস দিন।
শ্নংপ্রেঙ পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন আঁধার নেমে এসেছে। মাটিতে পা পড়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম যে জায়গাটা আসলে কতটা নির্জন। কয়েকটা হোমস্টে আর কিছু দোকান থেকে ভেসে আসা টিমটিমে আলো ছাড়া আশপাশ বেশ অন্ধকার। উমঙ্গত নদীতীরে আমাদের তাঁবু খাটানো ছিল। নদীতীরে নামার রাস্তাটা কিন্তু খুব একটা সুবিধের নয়।
নামার কিছুক্ষণ পরেই আমরা বনফায়ারের চারিদিকে গোল করে বসে উষ্ণতাটা উপভোগ করতে শুরু করলাম। হাতে হাতে পৌঁছে গেলো ওয়াইনের গ্লাস, কিছু দূরের আর এক গ্রূপ থেকে কানে ভেসে এলো গিটারের টুং টাং। বাতাসে ভেসে এলো পাশের বনফায়ারের ফুলকিও। বালির মধ্যে পা দুটো কে একটু জমিয়ে বসিয়ে তাকালাম উমঙ্গতের দিকে, দেখলাম চাঁদের আলোয় আনমনে ভেসে যাচ্ছে ঝকঝকে জলমালা।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলো ঝলমলে রোদ্দুর আর বেয়াড়া এক মোরগের ডাকে। এরম উজ্জ্বল সকালে দ্বকি নদী (উমঙ্গত নদীর আরেক নাম) যেন আমাদের কাছে ডাকছিলো। আর সময় নষ্ট না করে আমরা পৌঁছে গেলাম নদীর ওপরে ঝুলন্ত সাসপেনশন ব্রিজে। তবে সাবধানে, একসাথে অনেকে থাকলে ব্রিজটি দুলতে শুরু করে। ব্রিজের রেলিংটা ভাল করে ধরে একবার নিচে উঁকি মারুন, দেখবেন সূর্যের আলোয় উমঙ্গত ঝলমল করছে।
এরম পারফেক্ট দিনে একটা নৌকা সওয়ারি বাদ দেওয়া যায় না। স্থানীয় এক মাঝি শুধু বোট রাইড নয়, আমাদের ব্রেকফাস্টেরও বন্দোবস্ত করে দিলেন। বেশ কয়েকটা রুটি আর অমলেট খেয়ে বোটে নেমে পড়লাম। শুরু হলো আমাদের নৌকা ভ্রমণ।
এই নদীর জল এতটাই পরিষ্কার যে জলপৃষ্ঠের কাছে মুখ নামিয়ে আনলে নিচে মাছেদের আনাগোনা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। যতই নদীর মাঝে মাঝে বোল্ডার থাক, ভাল করে সেই জলের দিকে তাকালে যেন মনে হয় নদীর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটা পান্না রঙের আভা।
ছুঁয়ে দেখলাম, জল বেশ ঠান্ডা। কয়েকবার এও মনে হল যে এখনই জলে নেমে পরি। কিন্তু আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা হওয়ায় জলে পা ডুবিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম একটা খরস্রোতা ঝর্ণার দিকে, যার ফেনিল পাদদেশ ভর্তি হাজার বুদ্বুদে। দেখা পেলাম কয়েকজন জেলের। তারা নদী মাঝের বিভিন্ন বোল্ডার এর ওপরে টানটান ছিপ হাতে স্থির হয়ে বসে, বঁড়শিতে টানের অপেক্ষায়।
নদীখাতের পাশে খাড়া উঠে যাওয়া পাথুরে প্রাচীরের খাঁজ থেকে স্থানীয় বাচ্চারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর জলে, ভেসে উঠছে কিছুক্ষন পর। সূর্যের আলোয় তাদের ভিজে শরীর তখন চকচক করছে। এমন শান্তি আর কোথায় আছে।
শ্নংপ্রেঙ -এ কি কি করবেন:
যাদের অ্যাডভেঞ্চারের নেশা, তাদের জন্যে এখানে প্রচুর অপ্শন। কায়াকিং, ক্লিফ-জাম্পিং, স্নোর্কেলিং, স্কুবা-ডাইভিং, যা চাইবেন সেটাই পাবেন। তবে আঁটঘাঁট বেঁধে সকাল বেলা যাওয়াই ভালো, কারণ এক্টিভিটি গুলি করার সময় মোটামুটি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে।
প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্যে আছে মায়াবী উমঙ্গত নদীর ওপর স্নিগ্ধ বোট রাইড। দাম ৭০০ টাকা, ৪ থেকে ৭ জন যেতে পারেন। নদীর কাছে কত গুলি ছোট ট্রেক-ও আছে, যেখানে সবুজ প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য প্রজাপতি।
কখন যাবেন:
মেঘালয় ভ্রমণের জন্যে মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস সবচেয়ে আদর্শ। তবে যদি আপনার মনের মধ্যে থাকে বৃষ্টি নিয়ে আলাদা রোম্যান্স তাহলে মনসুনে মেঘালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য্য আপনার মন ভরিয়ে তুলবে।
থাকার জায়গা:
যেহেতু শ্নংপ্রেঙ বেশ ছোট্ট একটি গ্রাম, এখানে থাকার একমাত্র অপ্শন হয় কয়েকটি হোমস্টে, নয় তো ক্যাম্পিং। নদীর একদম পাশেই থাকতে চাইলে ক্যাম্প করাই শ্রেয়, এখান থেকে ভিউ অতুলনীয়। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষই জম্পেশ গরমাগরম ডিনারের দায়িত্ব নেন।
ডিনার সহযোগে একদিনের ক্যাম্পিং খরচ - ১২০০ টাকা
সমস্ত খাওয়া দাওয়া মিলিয়ে একদিনের হোমস্টে খরচ - ১২০০-১৫০০ টাকা
কীভাবে যাবেন:
সড়ক পথে
শীলং থেকে গাড়ি নিলে দ্বকি ৩ ঘন্টার পথ। বাস বা শেয়ার ট্যাক্সি বেশ সহজলভ্য। সদলবলে গেলে গোটা গাড়ি বুক করে নিতে পারেন, খরচ প্রায় ৩০০০ টাকা। দ্বকি থেকে শ্নংপ্রেঙ-এর দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করলে গাড়ির খবর পেয়ে যাবেন।
ট্রেনে
গুয়াহাটি রেলওয়ে স্টেশন সবচেয়ে নিকটবর্তী। গুয়াহাটি থেকে দ্বকির দূরত্ব প্রায় ১৮০ কিলোমিটার।
প্লেনে
দিল্লী থেকে প্লেনে করে গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে নামুন। ওয়ান ওয়ে টিকেটের দাম ২৫০০-৩৫০০ টাকার মতন।
নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।
বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন।
(এটি একটি অনুবাদকৃত/অনুলিখিত আর্টিকেল। আসল আর্টিকেল পড়তে এখানে ক্লিক করুন!)