বাংলায় “খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল” হোক বা হিন্দিতে “বালাম পিচকারি” হোক বসন্ত উৎসব কিন্তু তার রঙ সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত দোলযাত্রা সমস্ত নগরবৃন্দের মনে অদ্ভুত এক দোলা জাগিয়ে তোলে। গাছের পাতার ফাঁকে লেগে থাকা রঙের আভা আর উন্মুক্ত আকাশে উড়তে থাকা আবিরের শোভায় চারিদিকটা কেমন রামধনুর মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে ছোটবেলায় ঠাম্মার মুখে শোনা রাধাকৃষ্ণরলীলা খেলার কথা। আর রাধাকৃষ্ণ নাম উঠলে মথুরা-বৃন্দাবনের প্রসঙ্গ আসবে না তাও আবার হতে পারে? তাই এবারের হোলি উৎসব সকলের জন্য উদযাপন করা যাক মথুরা-বৃন্দাবনে।
ভাবছেন কীভাবে জানবেন এখানকার হোলি উৎসব সম্বন্ধে?? চিন্তা নেই আপনাদের জন্য ট্রিপটোর তরফ থেকে রইল মথুরা বৃন্দাবনের দোল উৎসবের কিছু অংশবিশেষ।
পৌরাণিক যুগ ও রামায়ণ-মহাভারতের জন্ম লগ্নে যে জায়গাটি হিন্দু ধর্মের কাছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে, উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত সেই বিখ্যাত শহরটির নাম মথুরা। মউজপুর, মধুপুরী, মধুবন, মধুরা, মদুরা বিভিন্ন সময়ে এই বিভিন্ন নাম বদলের মধ্যে দিয়ে আজ এই জায়গাটি হয়ে উঠেছে মথুরা। জানা যায়, সম্রাট অশোক এই মথুরাতে এসেই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। এই সমস্ত পৌরাণিক ঘটনার মধ্যেও মথুরার সবথেকে আকর্ষণের বিষয়বস্তু হল দোলযাত্রা। শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমিতে দোলযাত্রার মাহাত্ম্য যে অন্যরকম তা বলাই বাহুল্য।
মথুরার হোলি উৎসব:
রাধাকৃষ্ণের এই লীলাভূমিতে দোল পূর্ণিমা পালিত হয় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। এখানে বিভিন্ন পর্যায়ে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হোলি খেলা অনুষ্ঠিত হয় যেমন- ব্রজ কি হোলি, লাঠমার হোলি বৃন্দাবন প্রভৃতি। এই বছর মথুরাতে ২৩শে মার্চ থেকে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত চলবে এই রঙের উৎসব। শুধু মথুরাবাসী নয়, এই হোলি উৎসব পালন করার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে মানুষজন ছুটে আসেন তার আনন্দ উপভোগ করতে।
মথুরায় দোল উৎসব পালনের কিছু মুহূর্ত:
দোলযাত্রা শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে থেকে প্রাক্-হোলি উৎসবে মেতে ওঠে মথুরাবাসী। সেই সময় এরা একটি বিশেষ লাঠি খেলা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন; যেখানে পুরুষেরা মহিলাদের গায়ে রং মাখানোর চেষ্টা করলে মহিলারা লাঠি দিয়ে নিজেদের রক্ষা করেন। সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা মজা করে সেই সমস্ত পুরুষদের লাঠি দিয়ে প্রহার করতে থাকেন। এই সময় মহিলারা গোপিনীদের পোশাকে সেজে ওঠেন এবং পুরুষেরা গোপের পোশাক ধারণ করেন। প্রধানত এই উৎসবকে বলা হয় লাঠমার হোলি। মথুরা শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে রাধার জন্ম স্থান হিসেবে প্রসিদ্ধি বারসানা গ্রাম প্রধানত এই বিশেষ ধরনের হোলি খেলার জন্য বিখ্যাত। মহিলাদের হাতে লাঠির মার খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য পুরুষেরা ঢাল ব্যবহার করে থাকেন। এ সময় তারা বিভিন্ন গানও গায়। শুধু তাই নয়, এই লাঠমার হোলির পরদিন বদলা বলে একটি পর্ব পালন করা হয়, যেখানে পুরুষেরা মহিলাদের গায়ের রং মাখিয়ে আগের দিনের লাঠির মারের প্রতিশোধ নেন।
শুধু লাঠমার হোলি নয় মথুরার বারসানা গ্রামে পালিত হয় লাড্ডু হোলিও। এখানে দেশ বিদেশ থেকে আসা অসংখ্য মানুষজন রাধারানী মন্দির প্রাঙ্গণে এই বিশেষ হোলিতে অংশগ্রহণ করে। ছোট ছোট প্যাকেটের মধ্যে আবিরের সঙ্গে হাজার হাজার টন লাড্ডু মিশিয়ে মন্দির প্রাঙ্গন থেকে তারা দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। সেই লাড্ডুর প্যাকেট হাতে পেয়ে তারাও আবার একে অন্যের দিকে ছুঁড়ে দেয়। এইভাবে হোলি খেলার সূচনা করা। প্রায় দু’দিন ধরে এই উৎসব চলতে থাকে।
অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত পৌরাণিক ঘটনা:
পৌরাণিক গাথা অনুযায়ী, ছোটবেলায় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মা যশোদার কাছে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন রাধার গায়ের রং উজ্জ্বল এবং তাঁর গায়ের রং কেন শ্যাম বর্ণ। তখন মা যশোদা তাঁকে শান্ত করার জন্য বলেন যে রাধাকে রং মাখিয়ে তাঁর মত শ্যাম বর্ণ করে দিতে। সেই কথা শুনে কৃষ্ণ তাঁর বন্ধু-বান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে রাধা ও গোপিনীদের রং মাখাতে গেলে তাঁরা লাঠি নিয়ে কৃষ্ণ ও তাঁর সখাদের ভীষণ প্রহার করেন এবং ঠিক এরপর থেকেই এই লাঠমার হোলি খেলার প্রচলন হয়।
হোলি উৎসব পালন করা কিছু বিশেষ মন্দির:
• দ্বারকাধীশ মন্দির- ১৮১৪ সালে শেঠ গোকুল দাস এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন, যেখানে প্রত্যেক বছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই মন্দিরে ফুলের হোলি ও জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করা হয়।
• রাধারানী মন্দির- মথুরার এই মন্দিরে অসংখ্য ভক্তদের মাঝে খেলা হয় লাড্ডু হোলি।
• মদনমোহন মন্দির- সম্প্রতি মন্দিরটি সকলের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখানেও দোল উৎসবের ঘনঘটা প্রবল।
কবে যাবেন:
দোলযাত্রা উপলক্ষ্যে যদি আপনি মথুরা যান তবে দোলযাত্রার কিছুদিন আগেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া ভালো। কারণ হোলি উৎসবের পূর্বে এরা বেশ কিছু প্রাক হোলি অনুষ্ঠান ও আচার পালন করে থাকে, যেগুলো হয়তো পুনরায় দেখবার সুযোগ আপনার নাও হতে পারে।
কীভাবে যাবেন:
ট্রেন করে হাওড়া থেকে মথুরা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছনো যায়। সেখান থেকে কোনও গাড়ি বা অটোরিকশা ভাড়া করে আপনি আপনার থাকবার জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন।
মথুরার কিছু দর্শনীয় স্থান:
হোলি উৎসব পালন করার পরও যদি আপনার হাতে কিছুটা সময় থাকে তাহলে আপনি মথুরাতে বিশ্রাম ঘাট, যমুনা ঘাট, স্বামী ঘাট, সিকন্দ ঘাট, কংসের দুর্গ, গীতা মন্দির, জামা মসজিদ, গর্মেন্ট মিউজিয়াম, গোকুল, গোপাল লালজি মন্দির, রাজাঠাকুর মন্দির, ক্ষীরসাগর, মানসী গঙ্গা সরোবর, গোবর্ধন, রাধাকুণ্ড, জলমহল, রূপসাগর, নিত্যগোপাল মন্দির প্রভৃতি ঘুরে দেখতে পারেন। এমনিতেও মথুরার গলিতে গলিতে প্রচুর মন্দির আপনি খুঁজে পাবেন, যেখানে চাইলে আপনি লাড্ডু বা মাখন সহযোগে ভগবানকে ভোগ নিবেদন করতে পারেন।
মথুরা থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীর তীরে বৃন্দাবন অবস্থিত। ‘বৃন্দা’ অর্থাৎ তুলসী এবং ‘বন’ অর্থাৎ অরণ্য এই দুটি সংস্কৃত শব্দের মিলনে গড়ে উঠেছে বৃন্দাবন। তাই এখানে এখনও নিধুবন ও সেবাকুঞ্জ-এ দুটি তুলসী বন রয়েছে। বৃন্দাবন শহরের অলিতে গলিতে রাধাকৃষ্ণের অনেক মন্দির আছে, যার ইতিহাস আজও অমর হয়ে রয়েছে। এছাড়াও বৃন্দাবনে বিধবার নগরী বলে একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে প্রায় কুড়ি হাজারের বেশি বিধবা একসঙ্গে বসবাস করেন। বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারি অনুদানের মাধ্যমেই বিধবাদের বৃদ্ধাশ্রমগুলি চালানো হয়।
বৃন্দাবনের হোলি উৎসব:
মথুরা সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবনের হোলি উৎসবও বেশ আকর্ষণীয়। বসন্ত উৎসব পালনের জন্য কেউ মথুরা এলে বৃন্দাবন ভ্রমণ না করে বাড়ির পথে রওনা হন না। আবির ভর্তি প্যাকেট নিয়ে গলিতে গলিতে রাধে রাধে বলে আবির ছড়িয়ে শুরু হয় রং খেলার শুভ সূচনা করা হয়। প্রতিটি মন্দিরে দোরগোড়ায় রাখা হয় রঙের বালতি এবং পিচকিরি। সেই রং দিয়ে প্রত্যেক দর্শনার্থীর শরীর রাঙিয়ে তোলা হয়। এই উৎসব পালনের জন্য হাজার হাজার বিদেশি মানুষের ঢল নামে এই সময় বাঁকে বিহারী মন্দির চত্বরে। মন্দিরের ভেতরে কৃষ্ণমূর্তি কে ঘিরে চলে আবির খেলা। একসঙ্গে চারদিকে রাধা নাম ধ্বনিত হয়।
তবে এই বৃন্দাবনের হোলির বিশেষ আকর্ষণ হল বিধবাদের রঙের উৎসব। বিধবা, যারা সমাজে রঙিন সব কিছু থেকে বঞ্চিত অথচ এই বৃন্দাবনবাসীর কাছে তারা এই দিন হয়ে ওঠে রঙিন। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সুলভ ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এই বিধবাদের জন্য প্রত্যেক হোলিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে তারা সবাই সেই দিনের জন্য তাদের শ্বেতবস্ত্রে রং লাগিয়ে তা করে তোলে রঙিনবস্ত্র।
বৃন্দাবনের দর্শনীয় স্থান:
• গোবিন্দজী মন্দির
• প্রেম মন্দির
• মদন গোপাল মন্দির
• বাঁকে বিহারী মন্দির
• বিড়লা মন্দির
• ভূতেশ্বর মন্দির
• চন্দ্রোদয় মন্দির
• নিধুবন, কেশীঘাট ব্রহ্ম কুণ্ডু প্রভৃতি
কীভাবে পৌঁছবেন বৃন্দাবনে:
হাওড়া থেকে ট্রেনে মথুরা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে সেখানে থেকে অটোরিকশা করে ১৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পৌঁছনো যায় বৃন্দাবনে। তবে বৃন্দাবনের নিজস্ব স্টেশন রয়েছে, কিন্তু সেখানে ট্রেনের সংখ্যা খুব কম। তাই মথুরা স্টেশনে নেমে বৃন্দাবনের দিকে যাত্রা করাটাই শ্রেয়।
মথুরা, বৃন্দাবনের সঙ্গে সঙ্গে বারসানা, নান্দগাঁও খুব সুন্দরভাবে এই বসন্ত উৎসব উদযাপন করা হয়। শুধু বাঙালি নয়, অবাঙালিদের কাছে হোলি একটি বিশেষ উৎসব। কারণ এই দিনটিকে ঘিরে সকলের বেরঙিন জীবন হয়ে ওঠে রঙিন। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়া আবিরের গন্ধ কেমন সৃষ্টি মত্ততার সৃষ্টি করে। তাই যেখানেই আপনারা বসন্ত উৎসব পালন করুন না কেন এই বছর সর্তকতা বহন করে রং খেলুন। নিজে সুস্থ থাকুন এবং অন্যকে সুস্থ রাখুন। আর দয়া করে কোন অবলা প্রাণীর গায়ের রং দিয়ে তার ক্ষতি ডেকে আনবেন না।