কখনও কোথাও বেড়াতে গিয়ে মনে হয়েছে যে জায়গাটির আসল সৌন্দর্যের থেকে একই জায়গায় ইনস্টাগ্রামের ছবিগুলো দেখতে অনেক ভাল? ব্যাপারটা কিন্তু শুধুমাত্র "ফিল্টারের" কারসাজি নয়। হয়তো আপনি জায়গাগুলো গেছেন ওখানে ঘোরার বছরের সবথেকে সুবিধাজনক সময়ে, শীতকালে নয়।
শীতকালেই কিন্তু হিল স্টেশনগুলো ঢেকে যায় বরফের সাদা চাদরে, মরুভূমিতে উঠের পিঠে সাফারিও হয়ে ওঠে মনোরম, আর সি-বিচগুলোতেও লক্ষ্য করে দেখবেন আলাদা রকমের সৌন্দর্য চোখে পড়ে এই সময়েই। তাই রইল এমন কয়েকটি জায়গায় সন্ধান, যেগুলো শীতকালে হয়ে ওঠে আরও মনোরম, আর আপনাকে দেয় এক অতুলনীয় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
খাজজিয়ার
খাজজিয়ার কে ভারতবর্ষের মিনি সুইজারল্যান্ড এমনি এমনি বলা হয় না, আর একবার বরফ পড়তে শুরু করলে এই সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানোও বেশ মুশকিল। বরফে ঘেরা উপত্যকার একদিকে ঘন পাইন গাছের সারি, আর পটভূমিতে বরফশুভ্র পর্বতচূড়ার দৃশ্য আপনাকে মনে করিয়ে দেবে ইনস্টাগ্রামের ছবিগুলোর কথা। শীতের মরশুমে খাজজিয়ার এলে তবেই বুঝবেন বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এই সময়ে প্রকৃতির রূপ পাল্টে গিয়ে কতটা সুন্দর হয়ে ওঠে।
কীভাবে পৌঁছবেন : প্রথমে আসুন ২৪ কিলোমিটার দূরে ডালহৌসিতে, সেখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে আসুন খাজজিয়ার।
মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার জন্যে বা পর্বতপ্রেমীদের মনের মতো জায়গা হিসেবে সারাবছরই মুসৌরি থাকে জমজমাট, বিশেষত কাছাকাছি উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরের মানুষদের ভিড়ে এবং প্রায় ১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থান করার কারণে শীতকালে গোটা মুসৌরি ঢেকে যায় বরফের পুরু আস্তরণে। তাই শীতকালেই বরফসাদা মুসৌরি খুঁজে পায় নিজের শ্রেষ্ট রূপটিকে। মল রোড, লাল টিব্বা বা কেমটি ফলস, যে দিকে তাকাবেন, প্রতিটি জায়গাই যেন অতুলনীয়। তাছাড়া, শীতকালে পর্যটক সমাগমও বেশ কম হয় এখানে। তাই শীতকালে বরফ দেখতে যাওয়ার জন্যে সহজে পৌঁছনো যায় এমন হিল স্টেশন খুঁজলে মুসৌরি একেবারে আদর্শ।
কীভাবে পৌঁছবেন : আকাশপথে আসতে চাইলে জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্ট আর রেলপথে দেরাদুন স্টেশন নিকটবর্তী যোগাযোগকেন্দ্র। তবে মুসৌরি পৌঁছনোর জন্যে সড়কপথই সবথেকে ভাল। চণ্ডীগড়, দেরাদুন, দিল্লি, নিকটবর্তী সমস্ত বড় শহর থেকেই মুসৌরি পৌঁছনোর জন্যে বাস বা ট্যাক্সি পাবেন।
শিমলা
বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় পর্যটকদের কাছে শৈলশহর বলতে শিমলা অগ্রগণ্য। পাহাড়ের রানি নামে পরিচিত এই হিল স্টেশনটি কিন্তু এতটাই জনপ্রিয়, যে প্রতি বছর ট্যুরিস্ট সিজনে পর্যটকদের বিপুল ভিড়ে এবং যানজটে শিমলার সৌন্দর্যের বেশিরভাগটাই চাপা পড়ে যায়।
আপনারও যদি এরকম মনে হয়ে থাকে, তাহলে আমরা বলব একবার শীতকালে শিমলা গিয়ে তফাৎটা দেখুন। শীতকালের ঘন বরফে ঢাকা শিমলা ঠিক যেন কোনও হলিউড সিনেমার পুতুল শহর। তাছাড়া শিমলাতে পাবেন সবধরণের সুযোগ সুবিধা, তাই জুটি বেঁধে আর মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার জন্যে এর থেকে ভাল ডেস্টিনেশন আর পাবেন না।
কীভাবে পৌঁছবেন : শীতকালে শিমলা পৌঁছতে গেলে সড়কপথে যাওয়াই ঠিক। কাছাকাছি চণ্ডীগড়, নিউ দিল্লি, অমৃতসর, সমস্ত বড় শহর থেকেই নিয়মিত বাস পাওয়া যায়। শীতকালে টয় ট্রেনে করে শিমলা যাওয়ায় খুব উপভোগ্য। কালকা এবং শিমলার মাঝে চলমান ন্যারো গেজ এই ট্রেনটি সময় নেয় প্রায় ৬ ঘণ্টা।
অউলি
শিমলা বা মুসৌরি যদি আপনার শীতকালে দেখা হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আপনি যেতে পারেন উত্তরাখণ্ডের অউলিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত অউলিতে আপনি পাবেন অউলি-জসীমঠের কেবল কার রাইড, বিস্ময়ে হতবাক করে দেওয়ার মতো প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং গগনচুম্বী হিমালয় পর্বতমালা। তাই গ্রীষ্মকালে গরমের হাত থেকে বাঁচতে বহু পর্যটক ছুটে আসেন এখানে।
কিন্তু অনেকেই জানেন না, শীতকালে কীরকম অপরূপ হয়ে ওঠে অউলি। ঠান্ডা তো বটেই, কিন্তু যেসব পর্যটকরা ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে বরফে মোড়া অউলিকে দেখতে চান, তাদের জন্যে শীতকাল-ই শ্রেষ্ঠ। শীতকালে স্কি-রিসর্ট গুলোও যেন প্রাণোজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সারাবছর সুন্দর থাকা অউলি যেন হয়ে ওঠে ইউরোপের কোনও এক কোণের পাহাড়ি শৈলশহর।
কীভাবে পৌঁছাবেন : প্রথমে নিকটবর্তী বড় শহরগুলি থেকে বাস বা ট্যাক্সি করে পৌঁছে যান ঋষিকেশ, সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারেন অথবা ভোরবেলার বাস ধরে চলে আসতে পারেন জসীমঠ। শীতকালে তুষারপাতের কারণে সড়কপথ বন্ধ থাকে, তাই শুধুমাত্র জসীমঠ থেকে কেবল কার করেই অউলি পৌঁছতে পারবেন সহজেই।
জুলুক
শীতকালে স্পিতি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি? চলুন তাহলে শীতকালের জুলুক থেকে ঘুরে আসি। ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পূর্ব সিকিমের এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটি এককালে ছিল প্রাচীন সিল্ক রুটের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগকেন্দ্র। বর্তমানে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং হিমালয়ের অন্যান্য চূড়াগুলি দেখার জন্যে জুলুক আদর্শ একটি স্পট। গ্রীষ্মকালেও জুলুকের সৌন্দর্যের এতটুকু খামতি হয় না, কিন্তু শীতকালে ভিড় একদম কম হওয়ায়, খুব কম খরচায় পেয়ে যাবেন বেশ ভাল ভাল সব হোম স্টে।
জুলুক থেকে লুংথুঙ যাওয়ার পথে ৩২টি সুতীব্র বাঁকওলা রাস্তাটিও এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। সাহস করে যাবেন নাকি এই অদম্য অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে?
কীভাবে পৌঁছাবেন : জুলুক যেতে হলে সড়কপথ-ই ভরসা। গ্যাংটক থেকে ৪ ঘণ্টার এই পথে ট্যাক্সি বা শেয়ার ক্যাবের মাধ্যমে আসতে পারেন। এন.যে.পি রেলস্টেশন বা বাগডোগরা এয়ারপোর্ট হয়ে এলে জুলুক প্রায় ৬ ঘণ্টার পথ; আপনাকে সিকিমে ঢুকতে হবে এই অঞ্চলের প্রবেশদ্বার রংপো শহর হয়ে।
চাদর ট্রেক - বরফাবৃত জনস্কার নদী
এই অভিজ্ঞতাটি একমাত্র শীতকালেই অর্জন করা সম্ভব এবং ট্রেকটি একেবারেই শখের পর্যটকদের জন্যে নয়। একমাত্র যদি থাকে প্রবল অ্যাডভেঞ্চারের নেশা, আর শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি, এবং পৃথিবীর অন্যতম শীতল স্থানের সাথে মানিয়ে নেওয়ার দৃঢ়তা, তবেই এই ট্রেক আপনি করতে পারবেন। ফ্রোজেন রিভার ট্রেক নামেও পরিচিত এই পথে চলতে হবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার, বেশিরভাগটাই ঠান্ডায় জমে যাওয়া জনস্কার নদীর উপর দিয়ে। জনস্কার থেকে নেরাক যাতায়াতের জন্যে স্থানীয়রাও এই পথেই যাতায়াত করেন।
যাত্রাপথ মোটামুটি সমতল হলেও, -৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মারাত্মক ঠান্ডায় অভিজ্ঞ ট্রেকারদেরও সমস্যায় পড়তে হয়। শীতকালে বাড়িতে বসে কিছু করার বদলে যদি অ্যাডভেঞ্চার হয় আপনার প্রিয়, তাহলে চাদর ট্রেক অন্তত একবার অবশ্যই করা উচিত।
কীভাবে পৌঁছবেন : আকাশপথে আসা ছাড়া শীতকালে অন্য কোনও উপায় নেই। লেহ্ পর্যন্ত উড়ানে এসে সেখান থেকে ট্যাক্সি করে চিলিং আসতে হবে। চিলিং থেকেই চাদর ট্রেকের সূচনা।
জয়সলমীর
তাহলে কি যারা শীতকালে যারা পাহাড়ি ঠান্ডা সহ্য করতে পারেন না, তাদের জন্যে কিছুই নেই? ভাগ্যক্রমে তাদের জন্যে আছে থর মরুভূমি, এবং তার ঠিক কেন্দ্রস্থলে সোনালী শহর জয়সলমীর। ঐতিহাসিক দুর্গ, পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত দুর্গ, প্রাচীন রাজপ্রাসাদ, হলুদ বেলেপাথরের স্থাপত্যের নিদর্শন এবং মরুভূমির অজস্র অচেনা অজানা অংশ, কী নেই এখানে! যেসব পর্যটক উঠে চড়তে ভালোবাসেন বা সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং একটু গরম জায়গা ভালোবাসেন, তাদের জন্যে জয়সলমীর আদর্শ।
শীতকালে এই গন্তব্যস্থলের সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়ে যায়। যখন দেশের অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলো শীতের আক্রমণে কাঁপছে, তখন সারা দেশ থেকে একঝাঁক প্রাণবন্ত পর্যটকদের আগমনে জয়সলমীর হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
কীভাবে পৌঁছবেন : যাত্রাপথ উপভোগ করতে করতে জয়সলমীর পৌঁছনোর উপায় মূলত দুটি, ট্রেনপথে বা সড়কপথে। দিল্লি, জয়পুর বা মুম্বাই থেকে সহজেই ট্রেন টিকিট বুক করে আরামে জয়সলমীর পৌঁছনো যায়। আর যদি আপনি সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজ্যের মধ্যে দিয়ে রোড ট্রিপ করতে চান, তাহলে সড়কপথে গাড়ি চালিয়ে আসতে পারেন।
ভারকালা বিচ
শীতকালে বেড়াতে যাওয়ার কথা হচ্ছে কিন্তু তাতে কোনো সি-বিচের হদিশ না থাকা তো প্রায় পাপের সমান (অন্তত পর্যটকদের দুনিয়ায় তো বটেই)। তাই শীতকাল এলে ঘুরে আসতে পারেন ভারতবর্ষের একটি অন্যতম সুন্দর কিন্তু এখনো অতটা জনপ্রিয় না হওয়া ভারকালা বিচ থেকে। কেরালার এই ছোট্ট সামুদ্রিক গ্রামটিতে পাবেন হিপি সংস্কৃতির ছোঁয়া, আছে অসাধারণ কিছু সমুদ্রতট, আর দেশ বিদেশের পর্যটকদের পেট ভরানোর জন্যে এখানকার নাম করা রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায় বিখ্যাত সি-ফুডের পদগুলো।
ভারকালা বিচ, কপিল বিচ এবং ব্ল্যাক বিচ, যেখানে সারাবছর সেরম ভিড় থাকে না, শীতকালে সেজে ওঠে নতুন আঙ্গিকে। আর বন্ধুদের সঙ্গে এখানকার নাইটলাইফ আর কেরালার সবরকম খাবার উপভোগ করতে চাইলে ভারকালা ক্লিফের খাদ বরাবর বসা বাজারের থেকে শ্রেষ্ঠ জায়গা আর নেই।
কীভাবে পৌঁছাবেন : পার্শ্ববর্তী সমস্ত শহর থেকে ট্রেনে বা বাসে করে এখানে পৌঁছতে পারবেন। বিমানপথে কোচি বা তিরুবনন্তপুরম পৌঁছে সেখান থেকে ট্রেনে করে ভারকালা আসতে পারেন। আর ভারকালা ঘুরে দেখার জন্যে আছে ট্যাক্সি, টুক টুক বা ভাড়া করতে পারেন বাইক।
সুতরাং, আপনি যে ধরণের পর্যটক-ই হন না কেন, দৈনন্দিন রুটিন থেকে একটু সময় বার করে শীতকালে বেরিয়ে পড়ুন এই জায়গা গুলিতে ছুটি কাটাতে। এতদিনে যদি ভ্রমণের প্রেমে না পরে থাকেন, তাহলে এবারে তা নিশ্চিত।