হিন্দুদের প্রধান দেবতা রূপে যিনি পূজিত হন তিনি হলেন ভগবান শিব। এই আদিদেবতার আর্বিভাব সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় প্রাক বৈদিক যুগকে । বর্তমানে শিব যে রূপে পূজিত হন সেই রূপটি মূলত প্রাক-বৈদিক যুগ এবং বৈদিক যুগের শিব মূর্তির মিশ্র সংস্করণ। সৃষ্টির এই দেবতাকে কেন্দ্র করে নানান বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ভগবান ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু ভগবান শিবেরই আলাদা আলাদা রূপ। কিংবা শিব তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাস করেন কৈলাশ পর্বতে; ইত্যাদি নানান ধরণের জনমত শুনতে পাওয়া যায় ।
এই আদিদেবতা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় নানান রূপে পূজিত হন। ভারত ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গেও এই দেবতার আরাধনা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের এমনই শিব মন্দির দর্শনের জন্য পৌঁছে যেতে পারেন বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির ।
১০৮ শিব মন্দির প্রসঙ্গে কয়েকটি তথ্য
বর্ধমানের নবাবহাটে অবস্থিত এই ১০৮ শিব মন্দিরটির একটি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। কথিত আছে, নবাবহাট একসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মন্বন্তরের কারণে জনশূন্য হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময়েই ইংরেজদের সঙ্গে বর্ধমানের বিধবা রানী বিষ্ণুকুমারীর (যিনি রাজা তিলোকচাঁদের পত্নী ছিলেন) গোলযোগের সৃষ্টি হয়। তবে রানী ভক্তিমতী থাকায় একসময় বর্ধমান সমস্ত দুর্যোগ থেকে মুক্তি পায়। একদা রানী স্বপ্নে মন্দির নির্মাণের জন্য দৈবিক আদেশ পান। এই স্বপ্ন অনুসারেই ১৭৮৮ সালে এই মন্দির নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। স্বপ্নাদেশ অনুসারে রানীকে ১০৮ টি শিব মন্দির স্থাপনের কথা বলা হয়। একটি জপমালায় যেমনভাবে ১০৮ টি বীজ একত্রে মিলে একটি জপমালা নির্মিত হয়, ঠিক সেই আদলেই ১০৮ শিব মন্দির গঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটি মন্দির ছোট কুঁড়ে ঘরের আকৃতিতে এবং সমান আকারে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি মন্দিরের ভেতরে স্থাপিত আছেন ভগবান শিব।
মন্দিরে অবস্থিত একটি বিশালাকার জলাশয় সম্পূর্ণ মন্দিরকে দুইটি অংশে বিভক্ত করেছে। চারিদিকে ছোট বড় গাছের সমারোহ এবং পবিত্রতার সমন্বয়ে সজ্জিত এই মন্দিরে প্রবেশ করলে মনে হয় এখানে সাক্ষাৎ ভগবান শিবের অগাধ বিচরণ রয়েছে। সাপ্তাহিক পূজা ছাড়াও এখানে সংক্রান্তির পূজা এবং শিবরাত্রিও মহাসাড়ম্বরে পালিত হয়।
১০৮ শিব মন্দিরে মহাশিবরাত্রির পূজা
ভারতে ভগবান শিবকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড়ো এবং বিশেষ পূজা হল মহাশিবরাত্রি। সমগ্র পৃথিবীতে দেবতার আরাধনা করার মূল মন্ত্রটি হল জগৎ থেকে অন্ধকার এবং অজ্ঞতা দূরীকরণ। দক্ষিণ ভারতীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি পুজোর আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফাল্গুন মাসের ত্রয়োদশীর রাত এবং চতুর্দশীর দিন মিলিয়ে শিবরাত্রি পালন করা হয়।
পুরাণে শিবরাত্রিকে কেন্দ্র করে বহু গল্পগাথা উপলব্ধ আছে। কিন্তু প্রধান কাহিনি হল, সমুদ্র মন্থণের সময় বিষ পান; সেই সময় সাধারণ মানুষ থেকে ভগবানগণ সকলেই জগতের বিনাশ এর ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন। আর তাই জগৎকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং সাহায্যের প্রার্থনায় ছুটে যান ভগবান শিবের কাছে। ভগবান শিব সমস্ত বিষ নিজের কণ্ঠে ধারণ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। বিষ ধারণ করার ঘটনা থেকেই শিব ‘নীলকণ্ঠ’ নামেও পরিচিত হন। কিছু ভক্তদের মত অনুসারে এই ধারণাকে কেন্দ্র করেই শিবরাত্রি পালন করা হয় ।
শিবরাত্রি ব্রতে আরও একটি কাহিনি প্রচলিত আছে । একদা এক গরীব বৃদ্ধ কাঠ সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে যান, কিন্তু এতবড়ো জঙ্গল থেকে বাইরে আসার পথ হারিয়ে ফেলেন। ধীরে ধীরে সন্ধে নামে, অন্যদিকে বন্য পশুদের ভয়ে বৃদ্ধ দিশেহারা হয়ে একটি গাছে আশ্রয় নেন। দিনের বেলায় যে গাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করছিলেন সেই গাছকেই তিনি রাতের আশ্রয় হিসেবে বেছে নেন। কিছুক্ষণ পর নিদ্রামগ্ন হয়ে গিয়ে তিনি গাছ থেকে পড়ে যান। অতঃপর, এই গভীর অরণ্যে নিজের প্রাণ রক্ষার তাগিদে তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাঁকে জেগে থাকতে হবে। আর তাই তিনি স্থির করেন গাছের এক একটা পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে তিনি শিবমন্ত্র জপ করবেন। একসময় তিনি উপলব্ধি করলেন যে তিনি শিব লিঙ্গের উপর অজান্তেই হাজারটি বেল পাতা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে ভগবান শিব তুষ্ট হয়ে গরীব বৃদ্ধকে আশীর্বাদ স্বরূপ অনেক উপহার দেন। কালক্রমে, এই শিবরাত্রিতে ভক্তগণ সারারাত জেগে পূজার্চনা করেই ভগবানকে তুষ্ট করেন।
সমস্ত মন্দিরের মত বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দিরেও জাঁকজমক সহকারেই শিবরাত্রির দিন শিবকে আরাধনা করা হয়। প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিহার এবং ঝাড়খণ্ড থেকে প্রচুর ভক্তদের সমাগম হয়। ভক্তরা দুধ এবং জল দিয়ে স্নান করানোর পর ফুল,ফল এবং মিষ্টান্ন সহ দেবতাকে অর্চনা করেন এবং ভগবানের কাছে আশীর্বাদ কামনা করেন। ভক্তিমূলক গান বাজনা, আধুনিক লাইট-এর সজ্জা এবং পূজার সমন্বয়ে শিবরাত্রির পবিত্র রাত্রি যাপন করা হয় ।
বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দিরের ঠিকানা হল নবাবহাট, বর্ধমান -সিউড়ি ন্যাশনাল হাইওয়ে, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ- ৭১৩১০১
সময়-
এই মন্দিরটি প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকাল ৪টে থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা আছে ।
পারিপার্শ্বিক কিছু ভ্রমণস্থান
হাতে কিছুটা সময় থাকলে ১০৮ শিব মন্দির দর্শন করার পর সর্বমঙ্গলা মন্দির, বর্ধমান রাজবাড়ি, গোলাপ বাগ, খ্রিস্ট চার্চ পরিদর্শন করে আসতে পারেন ।
পথনির্দেশ
ট্রেনে - হাওড়া থেকে মেইন বা কর্ড লাইনের লোকাল ট্রেন চেপে পৌঁছে যান বর্ধমান স্টেশন। স্টেশন থেকে বাস বা টোটো ভাড়া করে ৪.৬ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান গন্তব্যে।
সড়কপথে - ইচ্ছা করলে গাড়ি করেও পৌঁছে যেতে পারেন বর্ধমান। হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল হয়ে বর্ধমান পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক।
সকল বর্ধমানবাসীর পক্ষ থেকে আপনার জন্য রইল সাদর আমন্ত্রণ।