২০২১ সালে ভারতের পরিস্থিতি যখন মহামারীর কবলে বিপর্যস্ত এই সময় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি খবর জানতে খুব ইচ্ছা হল। ইন্টারনেটের হাত ধরেই প্রতিবেশী দেশ ভুটানের করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গেলাম। ২০২০সালে ভুটান সরকার কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে ৬ই মার্চ ৭২ বছর বয়সী আমেরিকান পর্যটকের মাধ্যমে ভুটানে করোনা ভাইরাসের অনুপ্রবেশ। সেই সময় এই ছোট্ট দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না । গোটা দেশে সব মিলিয়ে ৩০০জন ডাক্তার ছিল। এই দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে, এই দেশে মাত্র একজন ডাক্তারই আইসিইউ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আছেন । এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে প্রথম দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃপক্ষ টেস্টের কিট থেকে শুরু করে পিপিই কিট সরবরাহ করতেন ।
সম্ভবত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ার কারণেই, এই দেশ মহামারী রোধে প্রথম থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করেছিল । ২০২০সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভুটান সরকার কর্তৃপক্ষ ন্যাশনাল প্রিপ্রেয়ডনেস এন্ড রেসপন্স প্ল্যান তৈরি করেন । এই প্ল্যান অনুযায়ী প্রতিদিন দেশের প্রতিটি মানুষকে সংক্রমণ সম্পর্কে বিশদে তথ্য জানানো হয় এবং তাদের স্বাস্থ্য এর প্রতি নজর রাখেন সরকার কর্তৃপক্ষ ।
সম্পূর্ণ দেশে মাত্র দুইজন মানুষ সংক্রমিত হওয়ার পরই সরকার কর্তৃপক্ষ টেস্টিং এবং ট্রেসিং উপর আস্থা রাখা শুরু করেন । সংক্রমিত রোগীকে দ্রুত আলাদা করে ১৪ দিনের নিভৃতবাসের ব্যবস্থা করেন ভুটান সরকার ।
২০২১ সালের গত ১০ই মে ভুটান সরকারের ভাইরাস সম্পর্কে রিপোর্ট অনুযায়ী সম্পূর্ণ দেশে আক্রান্তের সংখ্যা - ২০ জন, সুস্থ হয়েছেন - ২২জন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি,এই দেশের মোট আক্রান্তের সংখ্যা -১২৪১, সুস্থ হয়েছেন -১০৮৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে - ১জন ।
করোনা সংক্রমণ রোধের পিছনে ভুটানের সাফল্যের কারণ -
১. শাসনব্যবস্থা -
সংক্রমণ রোধে ভুটানের শাসনব্যবস্থা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন । ভুটানের রাজা ২০২০সাল থেকে প্রত্যহ ন্যাশনাল টিভির সাহায্যে পরিষ্কার ভাবে বিশদে এই ভাইরাস সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করেছেন ।
২. স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সাধন -
এই দেশের শাসনব্যবস্থা শুধুমাত্র মানুষকে সচেতন করেই ক্ষান্ত হননি। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করার চেষ্টা করেছেন । একটা সময় পর্যন্ত এই দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত না থাকলেও, উন্নত দেশ গুলি এবং WHO এর সহযোগে নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত উন্নত করার চেষ্টা করেছে ।
৩. তরুণ মানসিকতা -
এই দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রী বয়সের দিক থেকে তরুণ হলেও অভিজ্ঞতার দিক থেকে কিন্তু যথেষ্ট প্রশংসনীয় ।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সমগ্র বিশ্বকে সচেতন করছিলেন, ঠিক সেই সময়েই ভুটানে সরকার কর্তৃপক্ষ রেসপন্স টার্মস এর খসড়া তৈরী করার পরিকল্পনা শুরু করেন এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ন্যাশনাল প্রিপ্রেয়ডনেস এন্ড রেসপন্স প্ল্যান তৈরি করে ভুটানের নাগরিকদের মধ্যে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার অঙ্গীকার নেন । শুধু তাই নয়,মন্ত্রীরা স্বয়ং মানুষের কাছে গিয়ে সচেতন করে তোলেন ।
৪. টেস্ট, ট্রেস এন্ড ট্রিট প্ল্যান -
২০২০সাল থেকেই ভুটানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী টেস্ট, ট্রেস এন্ড ট্রিট প্ল্যানের উপর আলোকপাত করেছেন । পরীক্ষা করার পর পজেটিভ ব্যাক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলাদা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়াও পরীক্ষা করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রেজাল্ট দেওয়ার উপর নজর রেখেছিলেন ।
৫. জনসেবা -
২০২০ সালে অগাস্ট মাসে ভুটানে তিন সপ্তাহের লক ডাউনের ঘোষণা করা হয় । সেই সময় ভুটান সরকার কর্তৃপক্ষ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মিলে সাধারণ মানুষের কাছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিতেন । দেশে যে সমস্ত মানুষের ইমিউনিটি কম এবং বয়স্ক মানুষদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত পরিষেবা প্রদান করতেন ম্যাজেস্টি ওয়েলফেয়ার অফিস কর্তৃপক্ষ । এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত পরিষেবা ছাড়াও, যে সমস্ত মানুষের রেশন কেনার ক্ষমতা ছিল না তাদের বিনামূল্যে রেশন দিতেন ভুটান সরকার ।
৬. করোনা নিধনে ভুটানের গুপ্ত অস্ত্র -
প্যান্ডেমিকের সময়ে ভুটানের কমিউনিটি সার্ভিস এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাসেবকদের ছয় সপ্তাহের একটি ট্রেনিং প্রদান করেন ।ভুটানে এই ট্রেনিংটি 'দেসুপ্স ' নামে পরিচিত । ২০১১ সালে ভুটানের রাজা দেসুপ্স প্রোগ্রামের সূচনা করেন । বর্তমানে এই প্রোগ্রামের অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০। দেসুপ্স প্রোগ্রামটি মূলত দুঃসময়ে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের কারণেই গঠন করা হয়েছিল ।
৭. টিকা প্রদান -
গত ১২ই এপ্রিল ২০২১ এর সংবাদপত্র মাধ্যম থেকে জানা যায়, ভুটানে টিকা প্রদান শুরু হওয়ার মাত্র ১৬ দিনের মধ্যেই ৯৩% মানুষের টিকাকরণ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৭% মানুষদের ও টিকাকরণ ব্যবস্থা দ্রুত সম্ভবপর হবে ।
ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও এই ছোট্ট প্রতিবেশী দেশ থেকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সম্পর্কে কি কিছু শিক্ষা নিতে পারি না?