নান্দনিকতার সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে থাকে কোনও শিল্পীর সৃজনশীলতা এবং নৈব্যক্তিক দৃষ্টিভক্তি। আমাদের গ্রামবাংলার শিল্প এবং সৃজনী প্রতিভার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে একধরনের প্রবহমান সংস্কার, গ্রামীণ সুপ্রচলিত রীতি-নীতি এবং ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহের স্রোত। গ্রামীণ শিল্পরীতির সুলভ এবং সহজ-সরল প্রকাশনা বছরের পর বছর ধরেই পর্যটকসহ সকলকেই বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে থাকে।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বাংলার বিভিন্ন সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে আলপনা এবং অন্যান্য অঙ্কণ প্রণালী। গ্রামীণ বিভিন্ন উৎসবেও বিভিন্ন আলপনা দেওয়ার রীতি-নীতি চোখে পড়ে। যেমন- নবান্ন, লক্ষ্মীপুজো, পৌষপার্বণ এবং অন্যান্য নানা পার্বণে ঘরের দালানে নিপুণ হাতে আলপনা দেওয়ার পদ্ধতি প্রাচীন এবং সুপ্রচলিত।
সাধারণত আলপনা দেওয়ার ক্ষেত্রে খড়িমাটি, চক, বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে আলপনা দেওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার তারপিন তেলও ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তবে একটা জিনিস এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হবে, এই ধরনের আলপনার স্থায়িত্ব যথেষ্ট কম। কিছু সময় পরেই আলপনা উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কাজেই অনেক সময়ে গ্রামীণ শিল্পীরা এর বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজার চেষ্টা করেছে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পীরা আম আঁটির শাঁস চূর্ণ,শুকনো কুল চূর্ণ,চকগুঁড়া, মানকচু ও কলাগাছের কস বিভিন্ন রঙের সঙ্গে মিশিয়ে নিজেদের মতো রং তৈরি করেন। ওই রঙে আঁকা আলপনায় সারা বছর রঙিন করে তাদের মাটির ঘরের দেওয়ালে, আরও একটা কথা না বললেই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ির মেয়েরা এই কাজে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
আলপনার রং বানানোর নানা তথ্য পরিবেশন করার পাশাপাশি একটি গ্রামের কথা বলা প্রয়োজন। এই গ্রামের নামই হল আলপনা গ্রাম। বলাবাহুল্য এই গ্রামের প্রতিটি দেওয়ালই যেন এক একটি ক্যানভাস। শিল্পীদের রং-তুলির শোভায় গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালই সেজে উঠেছে নানা রকমের ছবিতে।
কোথায় এই আলপনা গ্রাম
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার ছোট একটি গ্রামের নাম টিকইল। আর এই টিকইল গ্রামেরই প্রতিটি ঘরের দেওয়ালে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কারুকার্যশোভিত ছবি। এই গ্রামের নান্দনিক শোভাই কোথাও গিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষের কাছে গ্রামটিকে পরিচিত করেছে আলপনা গ্রাম নামে।
গ্রামীণ সংস্কার
এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষই বিশ্বাস করেন যে, বাড়ির দেওয়ালে এই ধরনের কারুকার্য বাড়িতে একধরনের পবিত্রতার পরিবেশ নিয়ে আসে, একইসঙ্গে অতিথিদের মনও প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে এই ধরনের শোভা। বলাবাহুল্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ধরনের সংস্কারকে তাঁরা নিজেদের মনের মধ্যে বিশেষভাবে ধারণ এবং লালন করে চলেছে। অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর বাড়ির প্রতিটি ঘরেই বাড়ির মেয়েরা আলপনা দিয়ে থাকেন।
কীভাবে যাবেন?
বিমানপথে - বিমানপথে ঢাকা শহরে পৌঁছতে হবে এবং রাজধানী শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ৩১৭ কিলোমিটার। চাপাইগঞ্জ সদর থেকে আলপনা গ্রামের দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার।
(এমন বহু পর্যটকই রয়েছেন যাঁদের লোকায়ত এবং গ্রামীণ শিল্প-সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি রয়েছে বিশেষ আগ্রহ, এই বিষয়ে অনেকেরই বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, গবেষণাধর্মী বিভিন্ন কাজের সুবিধার্থে একবার এই গ্রামে সময় করে যাওয়া যেতেই পারে)